24.3 C
Dhaka
Friday, October 3, 2025

দেশজুড়ে আলোচনায় মাসুদ

আরও পড়ুন

নিজস্ব প্রতিবেদক :::

দেশের অর্থনীতির চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় সারাদেশে আলোচনা সৃষ্টি করেছে দেশের বাইরে চট্টগ্রামভিক্তিক শিল্পগ্রুপ এস আলমের মালিক সাইফুল আলম মাসুদের বিনিয়োগ। জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তিন মহাদেশের  অসংখ্য অফসোর প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা  বিনিয়োগ করেছেন সাইফুল আলম মাসুদ ও তার স্ত্রী।

ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, বৃটিশ আইল্যান্ডে বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে সাইফুল আলম মাসুদ ও তার স্ত্রী ফারজানা মাসুদের। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে এই দম্পতির সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নেবার বিষয়টিও উঠে এসেছে ডেইলি স্টারের সেই প্রতিবেদনে। বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায়ও সেই তাদের নাম। বিষয়টিকে ‘স্পষ্ট অর্থপাচার’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা৷

সিঙ্গাপুরে একটি বাণিজ্যিক ভবনে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ সিঙ্গাপুর ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮১০ কোটি টাকা (প্রতি সিঙ্গাপুর ডলারের বিনিময়মূল্য ৬০ টাকা ধরে) বিনিয়োগ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। এর কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম।  সিঙ্গাপুরের দৈনিক দ্য বিজনেস টাইমসে এই বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়।

দ্য বিজনেস টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়া এলাকার সেরেঙ্গন প্লাজার কাছে সেন্ট্রিয়াম স্কয়ার নামে নতুন এ বাণিজ্যিক ভবনটি নির্মিত হচ্ছে। ওই ভবনটির ২৭ হাজার ১৭৯ বর্গফুট বা ৪৯টি ইউনিট কেনা হয়। বাণিজ্যিক ওই ভবনটিতে ওই পরিমাণ জায়গা খুচরা বিক্রির জন্য বরাদ্দ ছিল। যার পুরোটাই একসঙ্গে কিনে নিয়েছিলো এস আলম গ্রুপ। প্রতি বর্গফুট জায়গা ৪ হাজার ৯৬৭ সিঙ্গাপুর ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ লাখ টাকা দামে কেনা হয়।

জানা যায়,  নব্বই দশকে চট্টগ্রামের খাতুনগন্জে ভোগ্য পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসার সুচনা করেন সাইফুল আলম মাসুদ। বেনামি প্রতিষ্ঠান খুলে স্থানীয় ব্যাংকের লোকাল এলসি’র অপব্যবহার করে বিপুল অর্থের মালিক হন তিনি। বিএনপি সরকারের সময় এক বিএনপি নেতার আশ্রয় প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠে এসআলম গ্রুপ। কানাঘুষা আছে, চট্টগ্রামের অনেক রাজনৈতিক নেতার বিনিয়োগ ছিলো এই প্রতিষ্ঠানে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ভিন্নরুপে আবির্ভূত হয় এসআলম গ্রুপ। একের পর এক ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান এসআলম গ্রুপ। কিন্তু সরকারের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে ২০১৪ সালের পর। ২০১৭ সালে  এস আলমের মালিকানায় বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকের ১৪ শতাংশের বেশি শেয়ার তুলে দেয়া হয়। ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতমুক্ত করার ‘সরকারি আবেদনে’ সাড়া দিয়ে সাতটি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ওই বছরের সাত মাসে বড় অংকের শেয়ার কিনে নেয় এস আলম গ্রুপ। অভিনব কায়দায় ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনকে “নীরব অভ্যুত্থান” হিসেবে আখ্যা দেয় ব্রিটেনের খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট।

এস আলম পরিবারের আধিপত্যে থাকা ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরি গ্লোবাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া নতুন করে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মালিকানায় এসেছে চট্টগ্রামভিত্তিক এই পরিবার। গুগল জরিপে তার কোম্পানির সম্পদের মূল্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। আর সাইফুল আলম মাসুদ ও তার স্ত্রী ফারজানা মাসুদের  এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের  বিনিয়োগ রয়েছে বিদেশে।

ইসলামী ব্যাংক থেকে গেল বছরের  নভেম্বর মাসেই দুটি ভুয়া কোম্পানি খুলে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো নাবিল গ্রুপ ও মার্টস বিজনেস লাইন। এর বাইরে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্ষ্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৩২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে নভেম্বরে এস আলম গ্রুপ নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে  এস আলম গ্রুপ এককভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নেয়। এর এই ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রনাধীন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যদিও এস আলম গ্রুপ সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারে। প্রতিবেদনে  আরো বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সন্দেহ করছে এস আলম গ্রুপ এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত পক্ষগুলো মোট এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে। এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও লাগাম টানা হয় নি প্রতিষ্ঠানটির।

ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ট্যাক্স সুবিধা পেতে  সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাসসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নামসর্বস্ব অফসোর প্রতিষ্ঠান খুলে বিনিয়োগ করেছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ। এসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাও ভুয়া।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাদক পাচারকারী থেকে শুরু করে স্টক প্রতারক থেকে কর্পোরেট আত্মসাৎকারী এবং পণ্য চোরাচালানকারী পর্যন্ত প্রতিটি ধরণের এন্টারপ্রাইজ অপরাধীরা অবশ্যই দুটি কারণে তাদের অপরাধ থেকে প্রবাহিত অর্থ পাচার করে থাকে।  প্রথমটি হ’ল অর্থ ট্রেইল নিজেই অপরাধের অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে; দ্বিতীয়টি হ’ল প্রতি অর্থ তদন্ত এবং বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্য হতে পারে।

সিএএমএস (Certified Anti-Money Laundering Specialist) লিন্ডা টমাস বলেন, অর্থ-পাচারের যন্ত্রটি আসলে যেই ব্যবহার করুক না কেন, অপারেশনাল নীতিগুলি মূলত একই। মানি-লন্ডারিংকে একটি গতিশীল তিন-পর্যায়ের প্রক্রিয়া হিসাবে বোঝানো হয়।  প্রথমত, অপরাধের সাথে সরাসরি যুক্ত থেকে তহবিল স্থানান্তর করা; দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ এবং, তৃতীয়ত, অপরাধীর কাছে আবারও অর্থ উপলব্ধ করা তার পেশাগত এবং ভৌগলিক উৎস  লুকিয়ে রাখা।’

সাইফুল আলম মাসুদ ও তার স্ত্রী ফারজানা মাসুদ কি প্রক্রিয়ায় এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন, সেটিকে আর্থিক ব্যবস্থাপনার  ‘বড় বিস্ময় ‘ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে ডেইলি স্টারের আলোচিত প্রতিবেদনে।

খাতুনগন্জের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে অর্থ পাচারের  কূটকৌশল সম্পর্কে ধারনা মিলেছে। তাদের মতে,  আমদানি রপ্তানি বানিজ্যে ‘আন্ডার ও ওভার ইনভয়েস’ কৌশল ব্যবহার করে অধিকাংশ বিজনেস গ্রুপ দেশের টাকা বাইরে পাচার করেছে। মুলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারে বড় অংশীদারত্ব রয়েছে এসআলম গ্রুপের।

 

এইবাংলা /হিমেল

- Advertisement -spot_img

সবশেষ খবর