::: নাদিরা শিমু :::
দীর্ঘ দুই বছর বিরতির পর ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলি খেলার মেলা শুরু হয়েছে সোমবার থেকে। চট্টগ্রামের লালদিঘি এলাকায় ঈদের পরদিন থেকে শুরু হওয়া এবারের আয়োজনে ভাটা পড়েছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই আয়োজন স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছে নানা কারণে। ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, তরুণদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়াতে এ বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন শুরু হয়। চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এ প্রতিযোগিতার প্রবক্তা।
সোমবার থেকে মেলা শুরু হলেও মূল আকর্ষণ জব্বারের বলী খেলা হবে মঙ্গলবার বিকালে। এ বছর খেলার ১১৪তম আসর বসছে।বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী ১২ বৈশাখ নগরীর লালদিঘী মাঠে প্রতিবছর এই বলী খেলা হয়। আর মেলায় রেওয়াজ অনুযায়ী দোকানিরা প্রতিবছর বসেন একই স্থানে।
কোতোয়ালি থানা মোড় থেকে জেল রোড, লালদিঘী হয়ে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও সিনেমাপ্যালেস মোড় পর্যন্ত মাঠের আশেপাশের প্রায় দেড় বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা বসে।দুই বছর বিরতির পর এবারের জব্বারের বলীখেলার মেলা জমবে ভালো – এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, ঈদের আমেজে এবারের খেলা ও মেলা অন্য রকম এক মাত্রা পাবার কথা। এছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলা ঘিরে উচ্ছ্বাস বাড়ার কারণে দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের ভীড় বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি দর্শনার্থীদের সংখ্যা।
২৪ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী এই বৈশাখী মেলার জন্য প্রস্তুত চট্টগ্রাম । এর মধ্যে বলী খেলা হবে ২৫ এপ্রিল। সরেজমিনে দেখা যায়, লালদীঘি মাঠে বলী খেলার মঞ্চ তৈরি হয়ে গেছে। আর ২৬ এপ্রিল বিকাল ৩টায় লালদীঘি মাঠে ঈদ আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে চাটগাঁইয়া ঈদ আনন্দ উৎসব উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে। তবে লালদীঘি মাঠে শুধু বলী খেলা হবে। আর বৈশাখী মেলা বসেছে লালদীঘির আশপাশের প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে।
আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা (চট্টগ্রামের ভাষায় বলী খেলা) ও বৈশাখী মেলা কমিটির নেতাদের মতে, মূলত এই জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামবাসীর জন্য অন্যরকম আনন্দ বয়ে আনবে। কিন্তু মেলায় অংশ নেয়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, দর্শনার্থী ও ক্রেতার সংখ্যা আশানুরূপ নয়। প্রচারণাকে দায়ী করছেন তারা।
কুমিল্লা থেকে মাটির জিনিসপত্র নিয়ে ঈদের দিন চট্টগ্রামে এসেছেন ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, ‘ ঈদের কারণে মেলা নিয়ে মানুষের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সোমবার সকাল থেকে কিছু দর্শনার্থী মেলা এসেছেন। অধিকাংশই শিশু কিশোর। নাগরদোলা নিয়ে আগ্রহী তারা। গ্রামীণ পণ্যসামগ্রী সম্পর্কে দর্শনার্থীদের কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ‘
চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলী খেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। চট্টগ্রামের মুরুব্বিদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম বলির দেশ।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। এই প্রতিযোগিতার শুরু ১৯০৯ সালে, যা আজও চলছে। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।
মধ্যযুগে সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি নিতেন, তাদের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তারা কুস্তি করতেন। সেখান থেকেই কুস্তি খেলার শুরু। কিন্তু জব্বারের বলীখেলার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল? কিভাবে এই প্রতিযোগিতা স্থান করে নিয়েছিল সারা দেশের মানুষের মনে? সেসব ইতিবৃত্ত নিয়ে আজকের লেখা।
১৯০৯ সালে প্রথম এই প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
ইতিহাস অনুযায়ী কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্লদের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ ছিলেন। তাদের বংশানুক্রমিক পেশা ছিল শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীররা ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।চট্টগ্রামের ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদন্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল বেশ নামকরা বলী ছিলেন।
আয়োজকরা বলছেন বর্তমানে পেশাদার বলী পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এখন আর কেউ বলী কিংবা কুস্তি খেলতে আগ্রহ দেখায় না। আগে গ্রামে গ্রামে এমন কুস্তি আর বলীখেলা হতো। আজ সেই দৃশ্য প্রায় কল্পনার পর্যায়ে চলে গেছে। এখন থেকে তরুণ প্রজন্মকে এ খেলার প্রতি আগ্রহী করতে হবে। যেন এই ঐতিহ্য কখনো হারিয়ে না যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, এখন জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চেনে। জব্বার মিয়ার বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হলেও এই আয়োজনে জৌলুশ বাড়েনি। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হলেও সাধারণ মানুষের কাছে স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছে জব্বারের বলী খেলা।
এইবাংলা/ তুহিন