Site icon দৈনিক এই বাংলা

গরুর মাংস নাগালে নেই মধ্যবিত্তের

::: নাদিরা শিমু :::

গবাদি পশুর খামার বাড়লেও গত তিন দশকে গরুর মাংস দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।  লাগাম ধরে রাখা সম্ভব না হবার কারণে মধ্যবিত্তের খাবারের মেন্যু থেকে অনেক আগেই বাদ পড়েছে গরুর মাংস। রমজানে গরুর মাংসের দাম আরেক দফা বেড়েছে। সেকারণে সেহরির মেন্যুতে গরুর মাংসের জায়গা হচ্ছে না মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারেও। নব্বইয়ের দশকে এক কেজি গরুর মাংস কেনা যেত ৫০ টাকায় বাড়তে বাড়তে ২০০৬ সালে গরুর মাংস মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যায়।

রমজানের প্রথম দিন চট্টগ্রামে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকায়৷দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানান, বাজারে গরুর সরবরাহ কমছে। তাই কেজিতে ৫০ টাকা মতো বেড়েছে। অর্থাৎ কয়েক দিন আগেও সাড়ে ৮০০ টাকায় এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া গেলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ টাকায়। তবে, এই দাম ক্রেতা-বিক্রেতার দরদামের ওপর নির্ভর করে ৯০০ পর্যন্তও ঠেকছে।

রমজানে রংপুর, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা নগরীতে সর্বনিম্ন ২৫০ গ্রাম মাংস বিক্রি হচ্ছে। গত রমজানেও রাজধানীর বাজারগুলোতে  গরুর মাংসের কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছিল ৭০০ টাকায়। ২০২২ সালের পুরোটা জুড়েই রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছিল ৬৫০ থেকে ৬৮০ টাকায়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পশুর উৎপাদন আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ লাখ ৯৯ হাজার বেড়ে হয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ গরু, ৪৫ শতাংশ ছাগল। বাকিগুলো মহিষ ও ভেড়া। দেশে জনপ্রতি মাংসের চাহিদা দৈনিক ১২০ গ্রাম। সে হিসাবে বছরে মাংসের চাহিদা ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টন। অর্থাৎ মাংসের উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া—সব মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম। তবুও কেন গরুর মাংসের দাম এতো বেশি সেই উত্তর নেই ব্যবসায়ীদের কাছে।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ তথা ক্যাবের তথ্য অনুসারে,  ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত গরুর মাংস  পাওয়া যেত ৬০ টাকা কেজিতে। ২০০১ সালেও মাত্র ৮০ টাকায় পাওয়া যেত এক কেজি গরুর গোশত। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এর দাম থাকে ১০৪ টাকা। কিন্তু ২০০৬ সালে এক লাফে দাম বেড়ে হলো ১৪০ টাকা। পরে ২০০৭ সালে ১৭০ টাকা, ২০০৮ সালে ১৯০ টাকা, ২০০৯ সালে ২২০ এবং ২০১০ সালে ২৪৭ টাকায় পৌঁছে গরুর মাংসের কেজি।

২০০৬ সালের পর থেকেই মুলত দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাবার কারণে গরিব ও মধ্যম আয়ের মানুষ মেহমানদারি বা কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া খাবার তালিকা থেকে বাদ দিতে শুরু করে।  বর্তমানে নিতান্ত বাধ্য না হলে গরুর মাংস নিম্মবৃত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্ত কারো টেবিলেই দেখা যায় না।

জানা যায়,  ঢাকা শহরে একসময়  আরও অনেক বেশি গরুর মাংসের দোকান ছিল। বর্তমানে গরুর মাংসের দোকান কিছুটা অনেক গেছে জানিয়ে গুলশান সংলগ্ন বাজারের গরুর মাংসের বিক্রেতা সাইদুর রহমান বলেন, এই ব্যবসায় লোকসানে পড়ে অনেকে অন্য ব্যবসা শুরু করেছে। আগে একটি চালু দোকানে দুই-তিনটি আস্ত গরুর মাংস একদিনে বিক্রি হয়ে যেত। সেই দোকানগুলোর ব্যবসাও এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গরু কিনে আনতে রাস্তা খরচ বাবদ অতিরিক্ত খরচ হবার কারণে দাম বেড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, বর্তমানে যে দামে বাজারে মাংস বিক্রি হচ্ছে তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। এটি অনেক বেশি। দাম বেশি হওয়ায় অনেকে মাংস কিনতে পারছেন না। অথচ মাংস আমিষের চাহিদা পূরণের বড় একটি উৎস। প্রতিবেশী দেশগুলোতে আমাদের চেয়ে অনেক কম দামে মাংস বিক্রি করছে।

গরু ব্যবসায়ীদের মতে, এক কেজি গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ পড়ে ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা।  এ হিসাবে দেশের মানুষের অনেক কম টাকায় গরুর মাংস খাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গরুর মাংস আরও কম দামে কিনতে পারে দেশের মানুষ। ৯০০ টাকা নয়, এক কেজি গরুর মাংস ৫০০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে পশুবাহী ট্রাকের চাঁদাবাজি, পশুর হাটগুলোর মাত্রাতিরিক্ত হাসিল আদায় বন্ধ করতে হবে। কারণ উৎপাদন ব্যয় কম হলেও এ চাঁদাবাজির টাকা ও বাড়তি হাসিলের অর্থও যুক্ত হয় পশুর দামের সঙ্গে।

এইবাংলা/হিমেল

Exit mobile version