Site icon দৈনিক এই বাংলা

টেকসই পরিকল্পনার অভাব, অব্যবস্থা আর দখলদারিত্বে সাগরকন্যা এখন হতাশার নাম

সানাউল্লাহ রেজা শাদ::

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ নিদর্শন, ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সৈকত বিশিষ্ট বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা আজ নানামুখী অব্যবস্থা ও অনিয়মের কবলে পড়ে হারাতে বসেছে তার স্বকীয়তা ও আকর্ষণ। একসময়ের “সাগরকন্যা” খ্যাত এ পর্যটনকেন্দ্রটি বর্তমানে পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠছে হতাশার প্রতীক।

সুন্দরবনের সীমান্তবর্তী দক্ষিণাঞ্চলের এই সৈকত একমাত্র স্থান বাংলাদেশে, যেখান থেকে একসাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। তবে আজ এ সৌন্দর্যের পেছনে ছায়া ফেলেছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বেহাল অবকাঠামো, পরিবেশ দূষণ, পর্যাপ্ত সুবিধার অভাব এবং প্রশাসনিক নজরদারির ঘাটতি।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে কুয়াকাটায় যাত্রা আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। একসময়ের দীর্ঘ ফেরি পারাপারের ভোগান্তি এখন ইতিহাস। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাত্র ৬-৭ ঘণ্টায় পৌঁছানো যাচ্ছে এই সমুদ্র সৈকতে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীরা জমি কিনে বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও টেকসই পর্যটন পরিকল্পনার অভাবে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।

স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীদের একাংশের অসাধু আচরণও কুয়াকাটার সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে। মৌসুম এলে হোটেল-মোটেলের ভাড়া পৌঁছে যায় আকাশচুম্বি পর্যায়ে। মানসম্মত খাবারের অভাব, অপ্রতুল শৌচাগার, পোশাক পরিবর্তনের জন্য জায়গার সংকট, বিশ্রামাগারের অনুপস্থিতি—এসবই পর্যটকদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।

কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান ভাঙনের মুখে পড়ায় পর্যটনের অন্যতম একটি আকর্ষণ হারাতে বসেছে এলাকা। এদিকে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব বসানো হলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, কুয়াকাটা পৌরসভা গঠিত হলেও গত ১৫ বছরেও পরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। শতাধিক আবাসিক হোটেল নির্মিত হলেও তাদের মধ্যে অধিকাংশই এখনো অনুমোদনহীন। সরকারি অনুমোদন পেতে গিয়ে জটিলতা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন হোটেল মালিকরা।

অপরিকল্পিত উন্নয়নের জ্বলন্ত উদাহরণ কুয়াকাটা মেরিন ড্রাইভ সড়ক। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়কটি উদ্বোধনের আগেই ভেঙে পড়েছে সাগরের পানির তোড়ে। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন জানান, মেরিন ড্রাইভটি নির্মাণে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছিল না। আপাতত পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বালুর বস্তা ও জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে।

সৈকতের পাড়জুড়ে দেখা যায় মোটরসাইকেল, ব্যাটারি চালিত ভ্যান, মাছ ধরার নৌকা, ছেঁড়া জাল আর পঁচা মাছের দুর্গন্ধে ভরপুর এলাকা। এ ছাড়াও, অস্থায়ী দোকানগুলোর খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল, পলিথিনসহ নানা আবর্জনা সৈকতের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে—সব মিলিয়ে সৈকত আজ যেন এক অনিয়ন্ত্রিত ময়লার ভাগাড়।

পর্যটকদের অভিযোগ, হোটেল গুলোতে সেবার মান তলানিতে। মৌসুমে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলেও তার বিপরীতে নেই কাঙ্ক্ষিত সুবিধা। হকারদের উপদ্রব ও অসচেতন আচরণের কারণে সৈকতে হাঁটাও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বলছেন, “এখানে এসে আনন্দ নয়, বরং দূর্ভোগ নিয়েই ফিরতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কুয়াকাটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি, পরিবেশবান্ধব ও পর্যটকবান্ধব টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা। সৈকতের সৌন্দর্য রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা ও পর্যটকদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই হতে পারে কুয়াকাটার ভবিষ্যৎ রক্ষার একমাত্র পথ।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, ‘কুয়াকাটায় অপরিকল্পিতভাবে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হয়েছিল। পানির তোড়ে সড়কটির বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গেছে। আপাতত পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ও জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রক্ষার চেষ্টা করছে।’
কুয়াকাটা নিয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

Exit mobile version