আল আমিন নাটোর
লোহার টুকরোয় হাতুড়ির ঘা পড়তেই উড়ছে স্ফুলিঙ্গ, জ্বলন্ত আগুনে পুড়ছে লোহা—আর তার মাঝেই একটানা কাজ করছেন কামাররা। যেন আগুন আর ঘাম মিশে তৈরি হচ্ছে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।
নাটোরের কামারপল্লি গুলোতে চলছে ঈদের আগের ব্যস্ততা, কিন্তু আশার চেয়ে বেশি ভর করেছে হতাশা।
সরজমিনে আজ বিকেলে তমালতলা বাজারের এক কামারশালায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে একজন বয়স্ক কামার গ্রাইন্ডিং মেশিনে ছুরি শান দিচ্ছেন। চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কয়লা, যন্ত্রপাতি, আর ছোট্ট ঘরের দেয়ালে ঝুলছে কাঁচা রশিতে সংযুক্ত বিদ্যুৎ লাইন।
অন্যদিকে আরেক কামারশালায় গভীর রাতে আগুনের পাশে বসে দুজন কামার একযোগে পিটাচ্ছেন গরম লোহা। হালকা আলোয় ভেসে উঠেছে তাঁদের কঠোর মুখাবয়ব, যা প্রতিফলিত করে এই পেশার দীর্ঘ সংগ্রামের চিত্র।
প্রতিবছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কামারদের কর্মশালায় থাকে কাজের চাপ। দা, বটি, ছুরি, চাপাতিসহ নানা ধরনের জিনিস তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন তারা। কিন্তু এবার সেই চেনা চিত্রে এসেছে বড় ধাক্কা।
অমল কর্মকার বলেন, “কাজের চাপ তো আগে থাকত। এবার তো চাপ কম, কাজও নাই। চাপ্পর বাদ দিয়া দাউলি-ছুরি শান দিয়া দিন যায়।
অসিম কর্মকার জানালেন, “গতবার যা কাজ করছিলাম এবার তিন ভাগের এক ভাগও পাই নাই। মানুষ পশু কিনতেছে কম, তাই আমাদের জিনিসও কম লাগছে।”
কামাররা বলেন, ঈদের আগে যা আয় হয়, তা দিয়েই বছরের বাকি সময়ের খরচ সামলাতে হয়। কিন্তু এবার কাজ না থাকায় পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
তবুও এই কঠিন সময়েও কামাররা হাল ছাড়েননি। কেউ নতুন মেশিন কিনতে পারছেন না, কেউ আবার সঠিক মজুরি না পেয়েও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন—শুধু পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রত্যয়ে।
স্থানীয়ভাবে কোনো ঋণ বা প্রশিক্ষণ না থাকায় এ পেশার মানুষ আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। কামারদের দাবি—সরকারি সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও লোনের ব্যবস্থা হলে টিকিয়ে রাখা সম্ভব এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প।
আধুনিকতার দৌড়ে অনেকেই ছুটছে যান্ত্রিক স্বাচ্ছন্দ্যের পেছনে। কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা আগুনের পাশে বসে জীবনের জন্য ঘাম ঝরাচ্ছেন, হাতুড়ির ঘায়ে গড়ে তুলছেন অস্তিত্ব। নাটোরের কামাররা যেন তাদেরই প্রতিচ্ছবি।