Site icon দৈনিক এই বাংলা

জাগরণের ধ্বনি জিয়াউর রহমান , জাতীয়  ঐক্যর প্রতীক

ওয়াহিদ জামান 

স্বাধীনতার পর সম্মৃদ্ধ  বাংলাদেশ গড়তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো জাতীয় ঐক্য। নানা ধারায় বিভক্ত বাংলাদেশীদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য তৈরির প্রথম পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সকল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, সংস্কৃতি এবং জাতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জাতীয় ঐক্য এবং একীকরণের উপর জোর দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। শহীদ জিয়াউর রহমানের  স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে শোষণমুক্ত, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। সুশাসন ও উন্নয়নের উদ্দীপনা দ্বারা জিয়াউর রহমান  গোটা জাতিকে আন্দোলিত করে গেছেন।

রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থে একটি অনন্য জনযুদ্ধে রুপ নেয়।  সারা বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অধিকার বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের এক ঐতিহাসিক ত্যাগের সংগ্রাম। এই জনযুদ্ধের মহানায়ক স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান । যাঁর সুদূরপ্রসারী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করে কাঙ্খিত স্বাধীনতা।

নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর জনগণের মধ্যে যে দেশপ্রেমের জন্ম দেয়, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ শেষে সর্বস্তরের মানুষের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করার প্রয়োজন  ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর সেটা আর সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের ছায়ায় লালিত যুব ও ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের নানা ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে ; এই কৃতিত্বের কথা সংগঠনের কর্মীদের বিনয়ী না করে তাদের কর্তৃত্ববাদী, অনেকক্ষেত্রে সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু করে তোলেছিলো। ৭০-এর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে মাধ্যমে বাঙালির একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা ‘আওয়ামী লীগ’ ফ্যাসিবাদী রুপে আবির্ভূত হয়। 

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে প্রথম দেশ, যে দেশটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো। ১৯৪৭ সাল থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা পূর্ববাংলার জনগণ  অত্যাচার, শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়নের শিকার হয়েছে। কিন্তু এ ভূখণ্ডের সংগ্রামী মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ  মেজর জিয়াউর রহমান  আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রদান করেন, ১৬ ডিসেম্বর তা বাস্তবে পূর্ণতা পায়। কিন্তু ৭১ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের অমনোযোগ ও প্রশ্রয়ের কারণে দলীয় দুর্বৃত্তায়ন প্রকট আকার ধারন করে।  সরকারূ দলের  ছাত্রসংগঠনের গুটিকয়েক নেতা ও কর্মী সারাদেশে নানা রকম অপকর্ম চালায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সুবিধাবাদীদের চেহারা হয়ে ওঠে ভিন্ন রকমের।

 স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিলো। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এই সরকার পদ্ধতি চালু করা হয়। ফলে এটি পরিচিত হয়ে উঠে বাকশাল হিসেবে। জাতীয় ঐক্য গড়ে না তোলে  দেশের অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই এমন ফ্যাসিবাদী  সরকার পদ্ধতি ছিল গণতন্ত্রের প্রতি বিরাট আঘাত। একারণর দেশে -বিদেশে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন  শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের  মধ্য দিয়ে যে বাঙালীর রক্তস্নাত ঐক্য গড়ে উঠেছিলো তা স্বপ্নভঙ্গে রুপ নেয় বাকশাল সৃস্টি ও দুঃশাসনের কারণে।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে মাত্র ৪১ বছর বয়সে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের তরুণতম রাষ্ট্রনেতা। জিয়ার রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিলো তরুনদের ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ নিয়ে জিয়াউর রহমানের  কর্মকুশলতা, সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদেরকে আশাবাদী করেছিলো। কৃষি, পোষাক শিল্প নিয়ে  জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা;  সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি যেসব কাজ করছিলেন তা দৃষ্টান্তমূলক। জিয়াউর রহমান তার ভাষণে বলেছিলেন , ‘দেশের কৃষক, শ্রমিক, তরুণ—তাদের হাতে চাই দক্ষতার চাবিকাঠি, সনদের ভার নয়।’ জিয়াউর রহমানের  জ্ঞান ও উদাহরণমূলক কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে  আমাদের তরুণ সমাজ দেশ ও সমাজের জন্য এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। শহীদ জিয়াউর রহমানেন রাজনৈতিক দর্শন শুধুমাত্র একটি অতীত অধ্যায় নয়, বরং তা তরুণ প্রজন্মের সামনে আজও প্রাসঙ্গিক। তরুণরা আজ নিজেদের কর্মসংস্থান ও ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দোলাচলে। তরুণদের সামনে এখন রাজনীতি বিভক্ত, নেতৃত্ব সংকটে, রাজনৈতিক  আদর্শ বিলুপ্তির পথে তখন শহীদ জিয়ার চিন্তাকে নতুনভাবে পাঠ করা প্রয়োজন। তরুনদের ক্ষমতায়ন নিয়ে জিয়াউর রহমানের অর্জন উদযাপিত হওয়া প্রয়োজন।এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের পাশাপাশি  জিয়াউর রহমানের কর্মমুখী চিন্তাধারা আবারও আলোচনায় আসা উচিত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনই হলো ‘শাসন কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, বরং কার্যকর বাস্তবায়নের শৃঙ্খলিত রূপরেখা।’

শহীদ জিয়া  যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন দেশ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন, অর্থনীতিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত। নাগরিকরাও মনোবলের দিক থেকে চরম হতাশাগ্রস্ত। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্যেন দর্শন নির্মাণ করেন, তা ছিল আত্মনির্ভরতার, শৃঙ্খলার ;  সর্বোপরি, গণভিত্তিক মানবিক রাষ্ট্রচিন্তার এক নতুন খসড়া। রাস্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েই জিয়াউর রহমানের মুখে অনুরণিত হয় ঐক্যর বার্তা। তিনি বলেছিলেন,  ‘ জাতির উদ্দেশ্য হলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। প্রকৃতপক্ষে আমাদের উন্নতি ও শান্তি নির্ভর করে জাতীয় ঐক্যের উপর।’

বিভেদ, বৈষম্য ও সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে জাতীয় ঐক্যে প্রতিবন্ধকতা দুর করার পরিকল্পনা নেন জিয়াউর রহমান।  বিশেষত দেশ কীভাবে চলবে বা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হইবে জাতীয় ঐক্য, সেই বিষয়টি সেই বিষয়টি তার রাজনৈতিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে  একে অপরকে উৎখাত বা মূলোৎপাটনের রাজনীতির সংস্কৃতি জাতির উপর চেপে বসে। অল্প সময়ের মধ্যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান  এমন সব মৌলিক আদর্শ, স্থায়ী সংস্কার ও জাতীয় ঐক্যের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নির্মাণ করে গেছেন, বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্র যত দিন বেঁচে থাকবে তত দিন জিয়ার জয়গান গাইবে।

অস্থির সময়ে সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনতার জিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন।   বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দর্শনের প্রবর্তন, আধুনিক ও উৎপাদনমুখী, তরুন নেতৃত্বের  বাংলাদেশ গড়ার মেনিফেস্টো ;  ১৯ দফা রচনার মতো ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে জিয়া এ দেশের জনতার মাঝে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন।স্বাধীনতাকে একটি দিবসে সীমাবদ্ধ  রাখার অপচেষ্টা রুখে দিয়ে বাঙালির বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ প্রবর্তন  – জাতির সংকটে অনুরণিত হয়েছে  প্রতিদিন, প্রতিপলে, প্রতিপ্রাণে। তাইতো জিয়াউর রহমান  নিছক একটি নাম নয়, নিছক কোনো রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তি নন। তিনি একটি জাতির জাগরণের ধ্বনি, জাতীয়  ঐক্যর প্রতীক,  আত্মপরিচয়ের প্রতীক।

লেখক – ওয়াহিদ জামান, সিনিয়র সাংবাদিক

 

Exit mobile version