Site icon দৈনিক এই বাংলা

বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং ‘ রিস্কি’ ক্যাটাগরিতে

::: রাহাত আহমেদ :::

একদিকে ডলার সংকটের কারনে আমদানির এলসি খোলা দুরূহ হয়ে উঠেছে, একই সময়ে গ্যাসসহ জ্বালানি সংকট কৃষিকাজ, শিল্প কারখানার উৎপাদন তথা সাধারণ মানুষের  জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। এরমধ্যে নতুন দুঃসংবাদ বাংলাদেশের জন্য। বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি “মুডি” বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্হার ক্রেডিট রেটিং “নিউট্রাল” ক্যাটেগরি থেকে নিচে নামিয়ে “রিস্কি” ক্যাটাগরিতে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের জন্য মুডি’স ক্রেডিট রেটিং সর্বশেষ পর্যালোচনায় আউটলুক সহ ‘Ba3’ এ সেট করা হয়েছে।

ক্রেডিট রেটিং মূলত ক্রেডিট ঝুঁকি সম্পর্কে মতামত। রেটিংগুলি একটি স্বতন্ত্র ঋণ সমস্যা এবং ইস্যুকারী ডিফল্ট হতে পারে এমন আপেক্ষিক সম্ভাবনার ক্রেডিট গুণমানের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একটি দেশের দুর্বল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা,  প্রতিকূল ব্যবসা পরিস্থিতি অর্থনৈতিক অঙ্গীকারকে দুর্বল করে দেয়। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং বিনিয়োগকারীর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি “মুডি” বাংলাদেশকে  “নিউট্রাল” ক্যাটেগরি থেকে নিচে নামিয়ে “রিস্কি” ক্যাটাগরিতে শ্রেণীবদ্ধ করার বিষয়টি বিদেশি  বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

দেশের মোট রিজার্ভ নিয়ে বিতর্কের মাঝপথে নতুন খারাপ খবর এলো৷ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি একটি  দেশের  ব্যাংকিং ব্যবস্হাকে  চিহ্নিত করে যে ঐ দেশের সাথে ব্যবসা করা “ঝুঁকি পূর্ণ” তা যে কোন দেশের জন্য বড় দুঃসংবাদ। তবে অর্থনৈতিক  বিশ্লেষকদের মতে  ফিচের (Flitch)  ক্রেডিট রেটিং অনুযায়ী  সর্বশেষ বাংলাদেশ  ‘ BB ‘তে ক্যাটাগরিতে  স্থিতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে আছে।

ক্রেডিট রেটিং হল সাধারণ অর্থনৈতিক ও আর্থিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার একটি সূচক। একটি দেশের রেটিং আউটলুক সেই দেশের অর্থনৈতিক ও রাজস্ব পারফরম্যান্সের সম্ভাব্য দিক নির্দেশ করে।

মুডির দৃষ্টিভঙ্গি ছয়টি মূল চালকের উপর ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়।  বিশেষত, মুডি’স ব্যাঙ্কের পরিচালন পরিবেশকে স্থিতিশীল হিসাবে মূল্যায়ন করে; অবনতি হিসাবে সম্পদ ঝুঁকি; ক্ষয়িষ্ণু হিসাবে মূলধন; অবনতি হিসাবে লাভজনকতা এবং দক্ষতা; স্থিতিশীল হিসাবে তহবিল এবং তারল্য; – এসব প্যারামিটারে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ক্রেডিট রেটিংয়ে এমন অবনমন স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

মুডি, ফিচ,এসএন্ডপি, স্কোপ – এই চারটি রেটিং সংস্থাই ক্রেডিট রেটিং এর নির্দিষ্ট রেঞ্জের জন্য কিছু জেনেরিক বর্ণমালা ব্যবহার করে রেটিং পরিবর্তনের চিত্র ফুটিয়ে তুলে। মুডি( Moody) বিনিয়োগ গ্রেড হিসাবে বোঝায় যেগুলি ‘ Baa3 ‘এবং তার উপরে রেটিং দেওয়া হয়। একইভাবে Ba1 এবং এর নীচের রেটিংগুলি অনুমানমূলক গ্রেডের বিভাগে পড়ে৷ বাংলাদেশের জন্য মুডি’স ক্রেডিট রেটিং সর্বশেষ পর্যালোচনায় আউটলুক সহ ‘Ba3’ এ সেট করা হয়েছে। অন্যদিকে,  এসএন্ডপি, ফিচ এবং স্কোপ (  S&P, Fitch, Scope)  বিনিয়োগের গ্রেড সংক্রান্ত ইস্যুয়ারগুলিকে BBB-  এবং তার উপরে থেকে রেট ধরা হয় যখন BB+ এবং নীচের থেকে ফটকামূলক গ্রেড হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।

আলোচনা বাইরে রয়ে গেছে সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং হল একটি দেশের ‘ঋণযোগ্যতার’  মূল্যায়ন। এটি একটি নির্দিষ্ট দেশে ঋণ প্রদানের সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকির মাত্রা দেখায় কারণ এবং সরকার কর্তৃক জারি করা সমস্ত বন্ডে প্রয়োগ করা হয়।

সাধারণভাবে, ক্রেডিট রেটিং একটি দেশের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল, পেনশন তহবিল এবং অন্যান্য বিনিয়োগ স্টাটাস মিলিয়ে ঋণের যোগ্যতা পরিমাপ করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  ফলে একটি দেশের ঋণ নেওয়ার খরচের উপর এই রেটিং এর  বড় প্রভাব রয়েছে ।

আইএমএফয়ের ঋণ প্রাপ্তির খবর যতোটা স্বস্তির কারণ ছিলো তারচেয়ে বড় অস্বস্তির কারণ দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে ‘ মুডি’ র সর্বশেষ  এই রেটিং স্টাটাস। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সরকারী ঋণ ক্রেডিট রেটিং  বিশ্বের  প্রধান ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে কিনা সেটির উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

চলমান বৈশ্বিক মন্দার মাঝেও ছয় মাস আগে গ্লোবাল রেটিং এজেন্সি স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর  অর্থনীতির  হেঁচকি সত্ত্বেও বাংলাদেশের জন্য তার দীর্ঘমেয়াদী ক্রেডিট স্কোর বজায় রেখেছিলো। করোনাকালেও বাংলাদেশের   উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফর্দ, জিডিপি হার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য  প্রতিবেশীদের চেয়ে আর্থিক সংকটের আশঙ্কা থেকে দূরে রেখেছিল। ছয়মাস আগের প্রতিবেদন অনুযায়ী এসএন্ডপি ( S&P) বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং দীর্ঘমেয়াদে “BB-” এবং স্বল্পমেয়াদে ‘ B’ ক্যাটাগরিতে স্থীর রেখেছিলো।  “বি” এর স্বল্পমেয়াদী ক্রেডিট রেটিং মানে একটি দেশ প্রতিকূল ব্যবসা, আর্থিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু বর্তমানে আর্থিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ক্ষমতা রয়েছে। BB-এর দীর্ঘমেয়াদী ক্রেডিট রেটিং-এর অর্থ হল নিকট-মেয়াদে অর্থনীতি কম দুর্বল কিন্তু প্রতিকূল ব্যবসা, আর্থিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য বড় চলমান অনিশ্চয়তার সম্মুখীন।

সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসএন্ডপি বলেছে( S&P), উন্নত চলতি হিসাবের ঘাটতি কারণে বাংলাদেশ  বর্ধিত বাহ্যিক চাপের সময়কাল অতিক্রম করছে।  এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ রয়ে গেছে।

চারটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির জন্য, ক্রেডিট ঝুঁকির স্তরের উপর ভিত্তি করে রেটিংগুলি দুটি প্রধান গ্রুপে বিভক্ত করা হয় । উপাত্ত বিশ্লেষণে নিম্ন স্তরের ক্রেডিট ঝুঁকির জন্য বিনিয়োগ গ্রেড এবং উচ্চ স্তরের ঋণ ঝুঁকির জন্য অনুমানমূলক গ্রেড ধরা হয়।

S&P, Fitch এবং Scope-এর রেটিং AA থেকে CCC পর্যন্ত “+” বা “-” দিয়ে পরিবর্তন দেখানো হয়ে থাকে। মুডি’ ( Moody’s)  Aa থেকে Caa পর্যন্ত জেনেরিক রেটিং শ্রেণীবিভাগে 1 থেকে 3 পর্যন্ত সংখ্যাসূচক সংশোধক যুক্ত করে। সমস্ত মডিফায়ার প্রধান রেটিং বিভাগের মধ্যে আপেক্ষিক স্থিতি নির্দেশ করে।

ড. রেজাই করিম বলেন, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অবিশ্বাস্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কারণে।প্রথমত, রেটিংগুলি এক ধরণের নৈতিক স্যুশন হিসাবে কাজ করে যা উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আরও বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান আর্থিক এবং রাজস্ব নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য করে। সার্বভৌম রেটিংগুলি ভাল আর্থিক এবং রাজস্ব নীতিগুলির জন্য একটি প্রণোদনা হিসাবে কাজ করে।  কারণ এই নীতিগুলির কার্যকারিতা রেটিং পদ্ধতিগুলির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ গঠন করে৷

দ্বিতীয়ত, একটি অনুকূল রেটিং সরকার এবং কোম্পানিগুলিকে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে মূলধন বাড়াতে সক্ষম করে।উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় বিশ্বের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রেটিং এজেন্সির উপর অনেক বেশি নির্ভর করে।

শুধু সরকারি প্রকল্পে নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়ন সহযোগীদের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্যিক অর্থায়ন বা বিনিয়োগও পেয়েছে  দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক কোম্পানি। নতুন রেটিং সেই সক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, বলছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

যদিও ঋণ পরিশোধের অতীত ইতিহাস, ধারাবাহিকতা আর সক্ষমতার কারণেই বাংলাদেশ অর্থ লগ্নিকারীদের আস্থার জায়গায় পৌঁছেছে বলে মনে করা হতো। তাদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাই ভারত বাদে সার্কের অন্য দেশের চেয়ে এদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থায়নকারী সংস্থা ও দেশের কাছে এগিয়ে রেখেছে। আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলোও সাম্প্রতিক সাম্প্রতিক সময়ে  বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ঋণমান সূচক স্থিতিশীল রেখেছিল। একারণেই ইতিবাচক প্রভাব দেখা গিয়েছিল উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অর্থায়নে। নেগেটিভ রেটিং কতখানি রিস্কি সেটি সামনের পরিস্থিতি বলে দেবে।

পরিসংখ্যান বলছে, গেল বছরের দ্বিতীয় ভাগে  (জুলাই-ডিসেম্বর) বিদেশিদের ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি ৬০ শতাংশ কমেছে। আর ১০ শতাংশ অর্থ কম ছাড় করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা।ঋণ সহায়তাকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি যেমন কমেছে, ঠিক আগের দেয়া প্রতিশ্রুতির অর্থও ছাড়ে বেশ অনীহা দেখা যাচ্ছে।

Exit mobile version