সানাউল্লাহ রেজা শাদ, বরগুনা:
২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বিকেল পাঁচটায় ছেড়ে আসা ‘এমভি অভিযান-১০’ নামক একটি লঞ্চ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে রাত সাড়ে তিনটায় ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। লঞ্চে থাকা যাত্রীদের মধ্যে ৪৯ জন আগুনে পুড়ে মারা যায়, ৭২ জন চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন বিভিন্ন হাসপাতালে।
জানা যায়, ওইদিন দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত শুরু হয়। লঞ্চটি তখন নলছিটি উপজেলা অতিক্রম করছিলো। আগুন লাগার পরে লঞ্চটি নলছিটি ও ঝালকাঠি ঘাটে ষ্টপেজ করেনি। লঞ্চটিতে আগুন লাগার প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চলতে থাকে। তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে ছিল লঞ্চটিতে। পরে লঞ্চটি ঝালকাঠির দিয়াকুল নামক স্থানে গিয়ে নদীর তীরে নোঙর করে। তখন ভাগ্যক্রমে অনেক যাত্রী লঞ্চ থেকে তীরে নামতে পেরেছিল। অনেকে সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকের সলিল সমাধী হয় সুগন্ধা নদীতে। ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের পুরো টিম ঘটনাস্থলে এসে প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
সেদিনের ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনার ট্রাজিডিতে ৪৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়ে মারা যায়। ৭২ জন যাত্রীকে বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। অনেকের অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় ঢাকায় জাতীয় বার্ন ইউনিটে প্রেরণ করা হয়। ওই সময় চিকিৎসারত অবস্থায় আরও তিনজনের মৃত্যু ঘটে। অনেকের লাশ বিষখালী নদীর চড়ে, জালেও আটকা পড়ে।
বাংলাভিশনের গুগল নিউজ ফলো করতে ক্লিক করুন
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে থেকে তখন ২৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যাওয়ায় ২৩ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ওই সব মরদেহের নমুনা সংরক্ষণ করে বরগুনার পোটকাখালী গণকবরে অজ্ঞাত পরিচয়ে দাফন করা হয়। এই ঘটনায় নৌ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম সচিব তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি ঘোষণা করেন।
আগুনে যাত্রী পুরে যাওয়ার ঘটনায় ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর নৌ আদালতে ৮ জনকে আসামি করে মামলা করে। সেদিনই আদালতের বিচারক ও দায়রা জজ জয়নব বেগম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারী করেন লঞ্চ মালিকসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। ২৭ ডিসেম্বর দুপুর অভিযান লঞ্চ-১০ মালিক হামজালাল শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই ঘটনায় লঞ্চের মালিক সহ ২৫ জনকে অজ্ঞাত রেখে বরগুনা মূখ্য বিচারিক আদালতে এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একটি মামলা দায়ের করে।
বরগুনা পোটকাখালী গণকবরে দাফন করা অজ্ঞাতদের শনাক্ত করতে জেলা প্রশাসনের তত্বাবধানে ঢাকা সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের একটি টিম ২৩ মরদেহের পরিচয় শনাক্তের অনুকূলে ৪৮ স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করেন। যার মধ্যে ১৪ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হলেও অজ্ঞাত থাকে ৯ মরদেহের।
বরগুনা সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়নের মিতু আক্তার জানান, ঢাকায় মায়ের চিকিৎসা শেষে একই পরিবারের ৬ জনকে নিয়ে অভিযান লঞ্চে বাড়ি ফিরছিলেন। আগুন লাগার পরে লঞ্চটি যখন তীরে ফিরছিলো তখন মা লাফ দিতে গিয়ে পরে গেলে অপারেশন ক্ষতস্থানে আঘাত প্রাপ্ত হয়। এতে রক্তক্ষরণ হলে মা অসুস্থ অবস্থায় মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, ছেলেকে মায়ের সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে কিনারে ফেলে ভাই এবং ভাইয়ের বৌকে খুঁজে আনতে গিয়ে লঞ্চ পুনরায় নদীতে ভাসতে থাকে। এসময়ে আমার শরীরে আগুন লাগলে জীবন বাঁচতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। আড়াই ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর সকালে তীরে উঠতে পারি। সেদিনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা ভোলার নয়। দুর্ঘটনায় আড়াই ভরি স্বর্ণ সহ হারিয়েছি নগদ টাকা পয়সা। দুর্ঘটনার আজ তিন বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়ায় নাই।
সেই রাতের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ সাদিকুর রহমান ইতালির ভেনিস থেকে মুঠোফোনে বলেন, ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সকালে ইতালি থেকে ঢাকায় এসে বিকেলে অভিযান ১০ লঞ্চ যোগে বরগুনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। বরিশাল ঘাট পাড়ি দেয়ার পর ঘুম ভেঙে যায়। এরপরে লঞ্চটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ দেখতে পাই পিছনে আগুন লেগেছে। লঞ্চের স্টাফদের গাফিলতির কারণে সেদিন এতগুলো প্রাণ ঝড়ে গেলো। তারা পালিয়ে না গিয়ে যদি লঞ্চটি যখন ভিড়ছিলো তখন নোঙর ফেলতো মানুষগুলো সহজেই নেমে যেতে পারতো। আমি ও আমার পরিবার নিরাপদে নেমে যেতে পারলেও চোখের সামনে পুড়তে দেখেছি মানুষকে। আজ তিন বছর পার হলেও এখনো দোষীদের বিচার হয়নি। দ্রুততম সময়ে তাদের বিচার হোক এটাই প্রত্যাশা।
অভিযান লঞ্চের দুর্ঘটনা নিহত ৪০ জনের মধ্যে অনেক পরিবার কাটছে আর্থিক অস্বচ্ছলতায়। পরিবারের আয়ের প্রধান ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে আছে। গণকবরে দাফন দেয়া ৯ মরদেহের পরিবারের হদিস মেলেনি এখনো। নির্মিত হয়নি আজও স্মৃতি স্তম্ভ। অবেহলায় পড়ে আছে গণকবর, নেই কোন রক্ষণাবেক্ষণ।
ওই লঞ্চে অগ্নিকান্ডের দিন নবজাতক সন্তানকে দেখতে বরগুনার আসছিলেন বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের রিয়াজ হাওলাদার। লঞ্চে অগ্নিকান্ডে দগ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামী রিয়াজ হাওলাদারকে হারিয়ে দুই সন্তান শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে এখন দুর্বিষসহ দিন কাটছে তার।
একই দুর্ঘটনায় বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া এলাকার সুমন সরদার হারিয়েছেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে। সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়লে ঢুকরে কাঁদেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। স্ত্রী-সন্তান সবাইকে হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব।’
বরগুনা নদী পরিব্রাজক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট সোহেল হাফিজ বলেন, ‘সুগন্ধা ট্রাজেডি বারবার মনে করিয়ে দেয় দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে যাত্রীদের নিরাপত্তহীনতার কথা। নৌযানগুলোতে যাত্রীদের সুরক্ষাসামগ্রী খুবই অপ্রতুল। দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য এই পথে চলাচলকারী সব নৌযানে সুরক্ষাসামগ্রী বাড়াতে হবে।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘নিহত-আহত প্রতিটি পরিবারকেই সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। তারপরও স্মরণকালের ভয়াবহ এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের অসচ্ছল, অসহায় পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’