কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার প্রভাবে কুড়িগ্রামে নদীভাঙনের নতুন ঢেউ দেখা দিয়েছে। চলতি বছরে তীব্র বন্যা না থাকলেও শরতের শেষভাগে আকস্মিকভাবে বেড়েছে নদীভাঙনের প্রকোপ। ভিটেমাটি, ফসলি জমি ও স্থাপনা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদীপাড়ের শত শত পরিবার।
দৈনিক এই বাংলার সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১ হাজার ৪০৩টি পরিবার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবরের শুরুতে উজানের ঢল ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে জেলার ফুলবাড়ী ও সদর উপজেলায় ধরলা নদী, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারীতে দুধকুমার নদী, উলিপুর ও চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদী, আর রাজারহাটে তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙনে শত শত ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যাত্রাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীপাড়ের মানুষ ঘরবাড়ি সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিতে ব্যস্ত। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল আজিজ বলেন, “এবার অসময়ে নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এক রাতেই দুইশ গজের বেশি জমি নদীতে চলে গেছে।”
একই এলাকার বাসিন্দা মো. তাইজুল ইসলাম বলেন, “৬ অক্টোবর আমাদের ঘরবাড়ি দুধকুমার নদী ভেঙে নিয়েছে। এখন পরিবারের সবাই মিলে গবাদি পশুর জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি।” অপর বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, “প্রতি বছর বর্ষার সময় ভাঙনের প্রস্তুতি থাকে, কিন্তু এবার হঠাৎই নদী ভাঙা শুরু হলো। একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবরের শুরুতে যাত্রাপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি পরিবার রাতারাতি বসতভিটা হারিয়েছে। কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, অনেকে অন্যত্র চলে গেছেন।
বানিয়োপাড়া গ্রামের মনছনা বেগম বলেন, “আমার বাড়ি ছয়বার ভেঙেছে। এবারও ঘর নদীতে চলে গেছে। এখন আত্মীয়ের চরে আশ্রয় নেবো। ভাবছিলাম, বন্যা না আসলে বাঁচবো, কিন্তু ভাঙন থেকে রেহাই নেই।”
জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শরৎকালে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও আকস্মিক ঢল দেখা দিচ্ছে। এতে নদীর স্রোত বৃদ্ধি পেয়ে ভাঙন তীব্র হচ্ছে।
রিভারাইন পিপল সংগঠনের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, “এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। বর্ষার পর এত বৃষ্টিপাত মৌসুমের দিক থেকে অস্বাভাবিক। পাশাপাশি নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় পানি ধারণক্ষমতাও কমে গেছে, তাই প্রবল স্রোত তীরে আঘাত করছে।”
তিনি আরও বলেন, “নদীগুলোর সারাবছরের প্রবাহ বজায় থাকলে এ ধরনের ভাঙন অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় বৈশ্বিকভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো, বৃক্ষরোপণ এবং টেকসই নদী ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে।”
অন্যদিকে, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, নদীভাঙনের স্থায়ী সমাধান হলো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ। বর্তমানে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সুরক্ষার চেষ্টা চলছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, “এই বর্ষায় ৩৭টি পয়েন্টে ৫.৪৭ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৩৩ কোটি টাকার জিও ব্যাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এখনো জেলার প্রায় ১০০ কিলোমিটার নদীতীর অরক্ষিত। সেখানে স্থায়ী ব্লক নির্মাণে আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় প্রয়োজন হবে।”
এই বাংলা/এমএস
টপিক
