অর্থনীতি ডেস্ক ::
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই কমবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি, এমন তথ্য উঠে এসেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রতিবেদনে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চলতি অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও বেশ খানিকটা কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ২০২৪ অর্থবছরে ৬.৫ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৩ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.০ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত সর্বশেষ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনে এতথ্য জানানো হয়।
দ্রুত সামান্য প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পূর্বাভাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং ইউরো এলাকায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কারণে ভাল রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উন্নতিকে প্রতিফলিত হবে। মুদ্রাস্ফীতি ২০২৩-এ ৯.০ শতাংশ থেকে ২০২৪-এ ৬.৬ শতাংশে হ্রাস পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি হিসেবে ঘাটতি কিছুটা সংকুচিত হয়ে ২০২৩-এর জিডিপি-এর ০.৭% থেকে ২০২৪-এ জিডিপি-এর ০.৫% হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিনটিং বলেন, ‘সরকার বাহ্যিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় তুলনামূলকভাবে ভালোভাবে পরিচালনা করছে, একইসাথে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সমালোচনামূলক সংস্কারের অগ্রগতি করছে।’
গিনটিং বলেন, ‘এই মূল কাঠামোগত সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে- জনসাধারণের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা, দেশীয় সম্পদের সুসম বন্টন বৃদ্ধি করা, সরবরাহের উন্নতি করা এবং আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, যা বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং মধ্যমেয়াদে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
বিশ্বব্যাংক বলছে, এবার প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। আর এডিবির ধারণা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) আশা করছে চলতি বছর মুদ্রাস্ফীতি কমবে এবং অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। আইএমএফের প্রত্যাশা ধীরগতিতে হলেও বিশ্ব অর্থনীতি চাঙা হবে, যদিও মুদ্রাস্ফীতির গতিরোধ করতে ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি পাবে। সংস্থাটির ধারণা, উৎপাদন খাতে বিগত বছরের তুলনায় স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। ফলে কিছুদিন আগে যে মন্দার কথা বলা হয়েছিল, তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। যদিও চলতি বছরের আগস্টে সাধারণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ, যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৪ শতাংশ যা বাংলাদেশে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা প্রকাশ করেছিলো। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এবং বাজারব্যবস্থা অনেকটাই স্থিতিস্থাপক থাকবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন সামনের বছরের শুরু থেকে চায়নার অর্থনীতিতে সুবাতাস বইবে। যার কারণে বৈশ্বিক মহামন্দা রোধ করা যাবে।
তবে একটি বিষয়ে আইএমএফ সতর্ক করেছে, মুদ্রাস্ফীতি রোধ করাই অর্থনীতির সাফল্যের অন্যতম সূত্র নয়, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে না। কোনো প্রকার বাইরের হস্তক্ষেপ করে, প্রলোভন দেখিয়ে বাজারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করলে হিতে বিপরীত হবে। বাজারকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে অলিভার বলেন, ‘ব্যাংকগুলো দেনা পরিশোধ করার কারণেই মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্যই চেষ্টা করবে যেন মুদ্রাস্ফীতি নিযন্ত্রণে থাকে।’
বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৩-এ ২ দশমিক ৯ ভাগ হতে পারে, যেটা গত বছর ছিল ৩ দশমিক ৪ ভাগ। ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ১ ভাগ, এমনটিই ধারণা করছে এই বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থা। এ বছর মুদ্রাস্ফীতি হবে ৬ দশমিক ৬ ভাগ, ২০২২-এ ছিল ৮ দশমিক ৮ ভাগ, এর অর্থ হ্রাস পাবে ২ দশমিক ২ ভাগ। ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি হবে ৪ দশমিক ৩ ভাগ।
বিশ্বজুড়ে করোনার প্রভাবে মহামারি, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, প্রায় তিন বছর খাদ্য উৎপাদনে সংকট, ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা থেকে শুরু দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই টালমাটাল হয়ে গেছে। এই সংস্থা ধারণা করেছিল এ বছর ২৩টি দেশ মন্দার শিকার হবে, তবে এখন তাদের প্রত্যাশা সংকট কেটে যাবে এবং ভয়াবহ মন্দার শিকার হতে হবে না।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানি সংকটে পড়েছিল, একটা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের মূল্য কমতে থাকে, যাতে কিনা পাশ্চাত্যের দেশগুলো ভীত হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা এতটাই খারাপ হতে থাকে যে, ব্যাংকগুলো এলসি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে। রিজার্ভে সংকট সৃষ্টি হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২৩ বিলিয়ন ডলার। স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।
পিয়েরে অলিভার বলেন, ‘মন্দার হালকা একটা ঝুঁকি বিরাজমান, সেটা বিশ্বব্যাপী কিংবা কয়েকটি দেশে এমন ঘটতে পারে। আইএমএফ বড় ধরনের মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছে না।’
২০২৩-২৪ সালের প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদ ব্যক্ত করলেও রুশ-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত কাটবে না, চাঙা হতে কিছুটা সময় লাগবে, আইএমএফ এমনটি ধারণা করছে।
এই সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতি এখনো ঝুঁকির মধ্যে আছে, চায়না স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সতর্ক থাকলেও করোনা নিয়ে এখনো চিন্তার মধ্যে আছে, তা সত্ত্বেও বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, যার কারণে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। হতদরিদ্র শ্রেণির বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ছে। বলা হচ্ছে ধনী দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি কিছু কম হতে পারে এ বছর, ১০টি দেশের মধ্যে ৯টি ২০২৩ সালের তুলনায় সামনের বছর ব্যয়সঙ্কোচ করতে বাধ্য হবে। আইএমএফের ধারণা ২০২৪ সালে বেকারত্ব ৫ দশমিক ২ ভাগ হতে পারে, বর্তমানে এই হার ৩ দশমিক ৫ ভাগ। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশটি মন্দা এড়িয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা এড়িয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ হবে পশ্চিম ইউরোপের বাজার শক্তিশালী করা এবং মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করা। এটা মাথায় রাখতে হবে ১৯৩০ সালের মতো মহামন্দায় পড়তে যাচ্ছে না দেশটি।
২০২৩-২৪ সালে চায়নার অর্থনীতি দৃঢ় অবস্থানে থাকবে, এমনটি প্রত্যাশা করছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল। চলতি বছর দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন দাঁড়াবে ৫ দশমিক ২ ভাগ, ২০২২ সালে ছিল ৩ ভাগ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ বছর বিশ্বের মোট উৎপাদনের শতকরা ৫০ ভাগ চায়না এবং ভারত সরবরাহ করবে। বিশেষ করে, চায়নার বাজার যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে শুধু এশিয়ার নয়- গোটা বিশ্বে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। মূল সমস্যা হচ্ছে চায়নার স্থাবর সম্পত্তির বাজার অস্থিতিশীল। ২০২৪ সাল নাগাদ এই বাজার আরো আধুনিক করা হবে, যা দেশটির সরকার মারফত জানা যায়। চায়নার গৃহায়ন এবং নির্মাণশিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে, পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণেই অনেক গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠান কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছে। গৃহনির্মাণশিল্পে স্থবিরতা বিরাজ করলে আর্থিক খাতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে।
এদিকে, রাশিয়ার তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপ একজোট হয়ে কাজ করছে। তারা চায় রাশিয়া যেন কোনোভাবেই অপরিশোধিত তেল ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের বেশি বিক্রি করতে না পারে। রুশ অর্থনীতি আপাতত স্থিতিশীল, এ বছর প্রবৃদ্ধি বিগত বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩০ ভাগ বেশি হবে। আগামী ২০২৪ সালে হবে ২ দশমিক ১ ভাগ।
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হয়েছে অধিকাংশ দেশ। ঋন ও অকার্যকর আমদানি নীতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখা যাচ্ছে না বাংলাদেশে। আইএমএফসহ বিভিন্ন উৎস থেকে ১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার পর ডিসেম্বরে দেশের রিজার্ভও বাড়বে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্যের গতিবিধি, অভ্যন্তরীণ আর্থিক ও মুদ্রানীতির অবস্থান এবং বিনিময় হারের অস্থিরতা থেকে উদ্ভূত ঝুঁকিসহ বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার বিষয়।