Site icon দৈনিক এই বাংলা

অনুমতি ছাড়া অবরোধে সক্রিয় হলে বিএনপি থেকে বহিষ্কার

নাদিরা শিমু, নিয়াজ তুহিন  :::

চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর জেলা ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বিপাকে বিএনপি নেতা- কর্মীরা।  দলের অবরোধ কর্মসূচিতে শীর্ষ নেতাদের অনুমতি ছাড়া কোন মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেই বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে রাখা হয়েছে। দলের অবরোধ কর্মসূচিতে নিরব থাকা নিয়ে  চট্টগ্রামের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে বিষয়টি নিয়ে দাঁনা বেঁধেছে ক্ষোভ। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির এক যুগ্ম আহবায়ক বলেন, দলের আহবায়কের নির্দেশনা মেনে চলতে হচ্ছে। তার নির্দেশ ছাড়া কোন মিছিল, সমাবেশ করা যাবে৷ না। উনি বহিষ্কার করার হুমকি দিয়ে রেখেছেন।  একদিকে প্রশাসন অন্যদিকে দলের শীর্ষ নেতারা। কিভাবে অবরোধ কর্মসূচি পালন করবো?  

একই অনুযোগের সুরে কথা বলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা দলের আরেক নেত্রী। তিনিও তার নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।

তিনি বলেন, ‘ দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ান নিজের মুঠোফোন বন্ধ রেখেছেন। দলের নেতা কর্মীরা তার কোন নির্দেশনা পাচ্ছেনা।   অতি উৎসাহী হয়ে শহরের কোথা  কোন মিছিল সমাবেশ করলে তার জন্য ক্ষেপে যাচ্ছেন তিনি। কারণ উনার উপর নাকি প্রশাসনের চাপ রয়েছে। ‘

চট্টগ্রাম মহানগর, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের থানা পর্যায়ের  নেতা কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায় নভেম্বর শুরু থেকে নিজেদের মুঠোফোন বন্ধ রেখে আত্মগোপনে রয়েছেন  চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহবায়ক ডাঃ শাহাদাত হোসেন ও  সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর। 

নেতাকর্মীদের দেয়া তথ্য মতে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা হবার পর থেকে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ৩৮ টি ঝটিকা মিছিল বের করা হয়েছে। তবে কোন মিছিলেই অংশগ্রহনকারীদের সংখ্যা ত্রিশের কোটা অতিক্রম করে নি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী গ্রেফতারের পরদিন এনায়েতবাজার এলাকায় মিছিল বের করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা। সেই মিছিলেও অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো ছিলো না। আমির খসরু  গ্রেফতারের পর আহবান করা হরতালের দিনের চিত্র ছিল একই রকম। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায় চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে  স্থান পাওয়া দুই ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে একজন রয়েছেন দুবাইয়ে। অন্যজন ঢাকায়। চেয়ারম্যানের দুই উপদেষ্টার কাউকেই অবরোধের দিনগুলোতে চট্টগ্রামে দেখা যায় নি। এরমধ্যে উত্তর জেলা বিএনপির আহবায়ক গোলাম আকবর খন্দকার, যিনি একই সাথে দলের চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ; কঠিন সতর্কতা বার্তা দিয়ে রেখেছেন ইউনিটের অধিনস্থ নেতাদের।

উত্তর জেলা বিএনপির বেশকটি সুত্র আহবায়ক  গোলাম আকবর খন্দকারের ‘বহিষ্কার’ নির্দেশনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে আহবায়কের এমন ফর্মুলা উপেক্ষা করে দলের কর্মসূচিতে সক্রিয় থেকে বহিষ্কার হতে চান এমন নেতাকর্মীর সংখ্যাও কম নয়। অবরোধে সক্রিয় দেখা গেছে ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, মিরসরাইয়ের যুবদলের নেতাকর্মীদের। তফসিল ঘোষণার পর ফটিকছড়ি উপজেলায় সরওয়ার আলমগীরের অনুসারীরা মশাল মিছিল বের করে। 

এদিকে,  সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীমও শীর্ষ নেতাদের অনুসরণ করে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন অবরোধ  কর্মসূচিতে। বিএনপি নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায় মাহবুবুর রহমান শামীমের সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না মোবাইল ফোন বন্ধ রাখার কারণে। নেতাকর্মীদের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে  নিরবে সময় পার করছেন বিএনপি সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনও। সাবেক  প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য চট্টগ্রামের  এই নেতা। বাবাকে অনুসরণ করে অবরোধ কর্মসূচিতে নেই তার ছেলে ব্যারিস্টার হেলাল উদ্দিনও। নিজের অনুসারীদের মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর সক্ষমতার কারণে চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতিতে মীর হেলাল প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। 

নগর বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এখন পুলিশ মারমুখী। প্রতিদিন গ্রেফতার করা হচ্ছে, মামলা দেয়া হচ্ছে।  নেতাকর্মীরা ঘরে ঘুমুতে পারছে না, আন্দোলনে আর কত টিকে থাকা যায়। এসব নির্যাতন,  জেল জুলুম উপেক্ষা করে মাঠে থাকার মতো সাহসী  কর্মীদের আমরা মুল্যায়ন করতে পারি নি। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদল, উত্তর জেলা ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সবকটি কমিটি ব্যারিস্টার  মীর হেলালের পছন্দমত করার কারণে অবরোধে বিএনপির  সাংগঠনিক দূর্বলতা স্পষ্ট হয়েছে। সবকটি বলয়কে সমন্বয় করে কমিটিগুলো করা উচিত ছিলো। দলের সংকটে পদ বগলে নিয়ে ঘুমুচ্ছে সবাই। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সর্বশেষ কমিটির  আহবায়ক সাইফুল আলম  , সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম  তুহিন, সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আসিফ চৌধুরী লিমনসহ প্রথম সারির নেতাদের কারও দেখা মেলেনি রাজপথে। আন্দোলন করবে কে? ‘

সুত্রমতে,  অবরোধে মিছিল সমাবেশের খরচের জন্য শীর্ষ বিএনপি নেতার কাছ ছয় লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা নগর ছাত্রদলের আহবায়ক ও সদস্য সচিব, সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক। তবে বর্তমান কমিটির ছাত্রদল নেতাদের মাঠে না মিললেও শীর্ষ নেতাদের কোন নির্দেশনা ছাড়াই ‘পদবঞ্চিত’ ছাত্রদল -যুবদল নেতারা চোরাগোপ্তা ঝটিকা মিছিলে কিছুটা  সরব রয়েছে নগরীতে । 

একসময়ের চট্টগ্রামের বিএনপির নিয়ন্ত্রক আবদুল্লাহ আল নোমানকে। এই প্রথম চট্টগ্রামে বিএনপির অবরোধ  কর্মসূচিতে তার অনুপস্থিতি নেতাকর্মী ও বিএনপি সমর্থকদের হতাশ করেছে। নেতাকর্মীরা মনে করেন দলে প্রচণ্ড রকমের অবহেলার শিকার বলেই সংকটে তিনি সক্রিয় নন। অথচ কেন্দ্র থেকে জেলা, মহানগরের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই একসময় তার অনুসারী  ছিলেন। চট্টগ্রামে বিএনপির এক সময়ের কাণ্ডারি নোমানও নেই মাঠে। 

জানা যায়,  চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও নগর বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি ডাকসাইটে বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ানকে দক্ষিণ জেলার আহবায়ক করা হয়েছিলো ২০১৯ সালে। দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ,  নগর বিএনপি থেকে আবু সুফিয়ানকে আহবায়ক হিসেবে যুক্ত করে  দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি আনার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে গেল চার বছরে। আবু সুফিয়ানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মোস্তাক আহমেদকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব করে করা সেই আহবায়ক কমিটি হালে পানি আনতে পারি নি, বরং বহু ধারায় বিভক্ত করেছে দক্ষিণ জেলা বিএনপিকে। সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে ভুমিকা রাখতে পারে নি দক্ষিণ জেলা বিএনপি। নেতাকর্মীদের অভিযোগ  অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিন মাঠে নেমে পরদিন থেকেই আত্নগোপনে চলে যান দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক। 

দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান ও সাধারণ সম্পাদক আজগর ঢাকার  মহাসমাবেশের দিন গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আসামী হলে গ্রেফতার এড়াতে আত্নগোপনে রয়েছেন। যুবদলের নেতাকর্মীদের সাথে দক্ষিণ জেলা বিএনপি শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন। নবগঠিত ছাত্রদলের কমিটিতে পদ পদবি নিয়ে অসন্তোষের জেরে নিরব আছেন ছাত্রদলের ত্যাগী ও সক্রিয়  নেতারা। স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন কমিটিতেও পদবঞ্চিতদের অসন্তোষের রেশ কাটেনি। প্রচার রয়েছে বিএনপি ছাড়াও  তিন সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন একছত্র প্রভাব বিস্তার করেছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মীর হেলাল। আনোয়ারা ও সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির  কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ চরম আকার ধারন করে। সুত্রমতে, বিভিন্ন সাংগঠনিক শাখায় দুর্বল  নেতৃত্বের কারণে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ‘  এনামুল হক ‘ অবরোধ কর্মসূচি জোরদার করতে বেকায়দায় আছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগর,  চট্টগ্রাম উত্তর ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির  শীর্ষ নেতারা অবরোধকালীন সময়ে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।  নগর ও উপজেলায়  ছাত্রদল -যুবদলের গ্রুপভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝটিকা  মিছিল অবরোধে আত্নগোপনে থাকা এ অঞ্চলের  ডাকসাইটে বিএনপি নেতাদের মান ইজ্জত বাঁচিয়ে দিয়েছে, এমন পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষকদের। 

এইবাংলা/ হিমেল 

Exit mobile version