কক্সবাজার প্রতিনিধি :::
টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন নৌপথে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে চলছে কয়েকটি জাহাজ। নিয়ম লঙ্ঘন করে এসব জাহাজ চলাচলের কারণে মিয়ানমার সীমানা এলাকায় ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে ভরা পর্যটন মৌসুমে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে এই রুটে চলাচল করার উপযোগী নয় এমন দুইটি জাহাজ গত দুই বছর যাবত চলাচল করছে। এসব জাহাজের বেক্রসিং সনদ বা সমুদ্রসীমা অতিক্রম সনদ নেই। এসব জাহাজ নদী পথের চলাচলের অনুমোদন থাকলেও একটি চক্র কমদামে ভাড়া করে অধিক লাভের আশায় বঙ্গোপসাগরের মতো উত্তাল সমুদ্রপথে জাহাজ পরিচালনা করে আসছে।
জানা গেছে, নদীতে চলাচলের জন্য তৈরিকৃত জাহাজ, বিভিন্ন তথ্য গোপন করে একটি অসাধু চক্র বঙ্গোপসাগরের মতো উত্তাল পথে (টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে) পর্যটকদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকা শর্তেও আইনের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সংস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজ পরিচালনা করে আসছে। এসব অবৈধ জাহাজ চলাচলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে যে কোন মুহূর্তে মায়ানমার সীমান্তে বড় ধরণের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে কক্সবাজারের পুরো পর্যটন শিল্পের উপর প্রভাব পড়বে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে ১২টি জাহাজ চলাচল করছে। এসব জাহাজের মধ্যে ২টি জাহাজের নেই রুট পারমিট। এই জাহাজ দুইটি নদীপথের (অভ্যন্তরীন যাত্রীবাহী)। নিয়ম অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের উপকুলে চলাচল করতে হলে একটি জাহাজের ১৮টি নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। বিশেষ নক্সা পাশ করিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র নিয়ম মোতাবেক তৈরি হবে। তারপর করতে হবে সার্ভে। সার্ভে রিপোর্ট হাতে পেয়ে নৌ-নিট্রা দেবে রুট পারমিট, নূন্যতম ৪টি চ্যানেলসহ একটি ভিএইচএফ, ২টি শক্তিচালিত নোঙ্গর, নৌযানে কমপক্ষে ৪০০ মি: মি: ফ্রি বোর্ড সকল লোডিং অবস্থায় বজায় রাখতে হবে, পোর্টহোল, ডোর, হ্যাচ কভারসমূহ, রাবার সীল দ্বারা পানি নিরোধক এবং মেইন ডেকের নীচের সমস্ত কম্পার্টমেন্ট সমূহ পানি নিরোধক হতে হবে। হ্যাচ কোমিং এবং এয়ার পাইপসমূহের উচ্চতা কমপক্ষে ৭৫০ মি: মি: হতে হবে, হাইড্রোলিক স্টিয়ারিং, জিপিএস এবং রাডার সচল সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু উল্লেখিত নিয়মের একটিও নেই ওই জাহাজ দুইটিতে। জাহাজ টি হল এম.ভি রাজহংস এবং এম.ভি পারিজাত।
ইতিমধ্যে এই জাহাজ দুইটি বেশ কয়েকবার মিয়ানমার ঘেঁষা বঙ্গোপসাগরের উপকুলে ডুবো ডুবো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি সাগরে ঢেউ বাড়লে জাহাজগুলোতে রোলিং বেড়ে যায়। এতে যাত্রীরা একজন আরেকজনের উপর পড়েছে বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা না থাকলেও ত্রুটিপূর্ণ জাহাজ দুইটি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচল করছে প্রতিনিয়ত।
দাপ্তরিক তথ্য অনুযায়ী, জাহাজ দুইটি ঢাকা-ইলিশা-মজুচৌধুরীর হাট রুটে চলাচলের কথা থাকলেও চক্রটি তা টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলের জন্য আবেদন করেন ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। তখন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার মো: আরাফারত হোসেনকে আহবায়ক করে তিনজনের একটি কমিটি করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়। এই কমিটি ফেব্রুয়ারি মাসে সরেজমিনে টেকনাফের দমদমমিয়া ঘাটে এসে তদন্ত করেন। তদন্তে জাহাজ দুইটির মধ্যে রাডার, রাডার এনগ্রেল ইনডিকেটর, হাইড্রোলিক সিস্টেম চালু, হ্যাজ কুমিং এবং এয়ার পাইপ সমূহের উচ্চতা ৭৫০ মি: মিটারসহ সাগরে চলার ১৮ কায়টেরিয়ার কিছুই পাওয়া যায়নি। তারই আলোকে যাচাই-বাছাই পরিদর্শক টিম গত ২৬ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং এই প্রতিবেদনে জাহাজ দুইটি উক্ত নৌ-রুটে ঝুঁকিপূর্ণ, চলাচলের অনুপযোগী বলা হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। যেহেতু জাহাজ দুইটি উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী চলাচল করছে তাই উক্ত আদালতে আপিলের পরামর্শ দেন। কিন্তু চক্রটি প্রভাব খাটিয়ে এখানে পরিচালনা করছে জাহাজ দুইটি।
অন্যদিকে, এই রুটে এতোগুলো জাহাজের পর্যটকদের ওঠানামা করার জন্য ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জেটিও নেই। ফলে এই রুটে জাহাজ বাড়লে পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিও বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাজ পরিচালনাকারী তোফায়েল আহমদের সাথে কথা হলে তিনি জানান, জাহাজ ঘাটে আছে, এখন পর্যটক নেই, অনুমতি দিলেও কি না দিলেও কি? ঝুঁকি নিয়ে নদীপথের জাহাজ বঙ্গোপসাগরে এতদিন চালালেন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের নিয়ন্ত্রণে এবং সিরিয়ালে যেসব জাহাজ চলাচল করে সেগুলোর কাগজপত্র এবং সক্ষমতা যাচাই বাছাই করে বরাদ্দ দিই। কিন্তু যেসব জাহাজ আমাদের তালিকাভুক্ত নয় সেসব জাহাজ নিয়ে আমরা কিছু বলতে পারি না। আমরা মনে করি এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আমাদের আদালত প্র্যাকটিক্যাল চিত্র না জানায় এসব জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেন। ফলে এগুলো নিয়ে বেগ পেতে হয় বলে জানান তিনি।
আবহাওয়া বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সতর্কতা সংকেত অনুসরণ না করে জাহাজ চলাচল করলে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি থাকেই। সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার অনুমোদন না থাকা জাহাজের চলাচল বন্ধ করতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও জাহাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দিলে জাহাজ দুইটি চলাচল অবৈধ হবে। তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান প্রতিবেদককে।
এইবাংলা/সিপি. তুহিন