Site icon দৈনিক এই বাংলা

ন্যায় বিচারের অধিকার

চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে সাবেক দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উপ পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুর পর দেশের আদালতগুলোর দৃশ্যপট নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়েছে।

গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যাচ্ছে মোহাম্মদ শহিদুল্লার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলা, সমন গোপন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি,  তড়িঘড়ি করে পরোয়ানা থানায় পাঠানোর মতো মানবাধিকার বিরোধী তথ্য।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে  আদালতের পেশকারের কারসাজির কারণে থানা হেফাজতে  সাবেক সরকারি কর্মকর্তার  চাঞ্চল্যকর মৃত্যু ঘটনা। নেজারত শাখার প্রতিবেদনে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে উল্লেখ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম । সেই সাথে ফুটে উঠেছে আদালত চত্বরে সমন গায়েবের মাধ্যমে ওয়ারেন্ট বাণিজ্যের চিত্রও।অথচ দেশের নাগরিক হিসেবে আদালতে  ন্যায্য এবং সর্বজনীন শুনানির অধিকার রয়েছে যেমন –

একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে বিচার কার্যক্রম ; সেই সাথে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী দ্বারা শুনতে হবে বাদি ও বিবাদীর বক্তব্য। নিরপেক্ষ আদালত সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য দেবে, সেই সাথে তথ্যগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হতে হবে। যদিও প্রেস এবং জনসাধারণকে অত্যন্ত সংবেদনশীল ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া যেতে পারে। যেখানে উপযুক্ত সেখানে নাগরিকদের জন্য আইনী পরামর্শকের প্রতিনিধিত্ব এবং আইনজীবী নিয়োগের  অনুমতি দেয়া বাঞ্চনীয়। স্বাধীন রাষ্ট্র ধারণায়বিচারক বা বিচারিক আদালত সাধারণত কল্যাণকর সিদ্ধান্তকেই অনুসরণ করে থাকে। সেই সাথে একটি আদালত বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ কীভাবে তার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তার ব্যাখ্যা পাওয়ারও একজন নাগরিকের  অধিকার রয়েছে।

প্রতিটি বিচারিক আদালত কোন বিশেষ মানবাধিকার আদালত না হওয়া শর্তেও মানবাধিকারের সুরক্ষার জন্যই এসব আদালত স্থাপন করা হয়ে থাকে।

মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে আদালতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত । কিন্তু আমাদের দেশে  মানবাধিকারের সাথে আদালতের সম্পৃক্ততার কিছু কাঠামোগত বাধা রয়েছে। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও  থানা হেফাজতে  সম্প্রতি সাবেক দূর্নীতি দমন কমিশন  কর্মকর্তা শহিদুল্লাহর ( সহকারী পরিচালক)  মৃত্যুর পর বিষয়টি নতুন করে প্রাসঙ্গিক হযেছে।

রাষ্ট্রের সকল সম্প্রদায়ের স্বার্থকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাখ্যা এবং আইনি ধারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য আইনের ফ্যাব্রিকের মধ্যে মানবাধিকারের উল্লেখযোগ্য অন্তর্ভুক্তির উদাহরণ বিবেচনা নেয়া উচিত।

মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করে থাকেন তাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকবে যে,  কেন নিয়মের অর্থে কাঠামোগত বিচ্ছিন্নতা শর্তেও নিম্ম আদালতসহ দেশের সবকটি আদালতের সামনে ন্যায় বিচারের স্বার্থে  মামলা করার অনুমতি দেয় এবং তা আইনী কাঠামোর  অন্তর্ভুক্তিতে বাধা দেয় না।

ফিরে আসি থানা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায়। যদিও পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে বিবাদী মোহাম্মদ শহিদুল্লার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা ছিলো। কিন্তু বিবাদীর স্বজনরা বলছেন কোন ধরনের সমন জারী করাই হয় নি ।

ফৌজদারি বিষয়ে সমন হল একটি আইনি দলিল যার অর্থ আপনাকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট তারিখ এবং সময়ে আদালতে হাজির হতে হবে একটি ফৌজদারি অভিযোগের জবাব দিতে। কিছু প্রাইভেট প্রসিকিউশনেও সমন ব্যবহার করা হলেও, সাধারণত কম গুরুতর মামলার জন্য সমন জারি করা হয়।  যেখানে একজন নাগরিক ( বাদি) আদালতে হাজির হওয়ার গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন বলে মনে করা হয় না।

একারণে উল্লেখিত মামলার ক্ষেত্রে  আদালতের আদেশে সমন জারী করার বিষয়ে বর্ণিত থাকলেও আসলে সমন পাঠানো হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। সমন কিভাবে এবং কার মাধ্যমে জারীর জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল সেটিও তদন্ত করা উচিত। দীর্ঘ এক মাস সময়েও কেন সমন জারী হলো না,  কারা এমন অনিয়মের  সাথে জড়িত- তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

মোহাম্মদ শহিদুল্লার বিরুদ্ধে বর্ণিত মামলায় ২৯-৮-২৩ এ প্রথম আদেশ, ২৭-০৯-২৩ এ দ্বিতীয় আদেশ নথিভুক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় আদেশে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে ৩০-১০-২৩ এ আদালতে উপস্থাপন করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। অথচ বাদী সময় চেয়েছে, ওয়ারেন্ট প্রার্থনা করেনি। স্বাভাবিকভাবেই এমন অযাচিত  ওয়ারেন্ট একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তার  মৃত্যুর কারণ হবার কারণে ‘আদালত উদ্দেশ্য মূলক আদেশ দিয়েছে’ – এমন ধারণা মুখ্য হয়েছে দেখা দিয়েছে।

কিন্তু মামলার বাদী রনি আক্তার তানিয়া গণমাধ্যমকে  বলেছেন , ‘আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী ম্যাক্সিমা চালক। তিন সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসার। মাঝে-মধ্যে জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করতেন। তার কথায় আমি মামলা করেছি। মামলার বিবাদীর সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। তার বাসায় আমি কখনও কাজও করিনি। শুনেছি, মামলার আসামি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গ্রেফতারের পর থানায় নাকি মারা গেছেন। খবরটি শুনে আমার খারাপ লেগেছে। সাংবাদিক যারা ফোন করছেন, তাদের আমি সত্যি কথাটা বলে দিচ্ছি।’

বাদি ( তানিয়া) , বিবাদিকে ( সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ) চেনে না ; তারপরও কেন আদালতে  অভিযোগ আনা হয়েছে সেটির চেয়ে আদালত কোন প্রক্রিয়ায় মামলাটি হ্যান্ডিলিং করেছে -সেটি খতিয়ে দেখা উচিত। যেহেতু বাদী কোর্টে হাজির ছিল না, সেক্ষেত্রে প্রসেস ফির টাকা কে,  কখন, কিভাবে জমা দিয়েছে-  তাও খতিয়ে দেখা উচিত।

দেশের প্রচলিত  আদালত  কাঠামোতে কত সহজে মিথ্যা  মামলা করা যায়, আদালতকে বিভ্রান্ত করা যায়- সেটি এই মামলার বাদি তানিয়ার বক্তব্যই স্পষ্ট করেছে।

মামলাটির নথি পর্যালেচনায় দেখা যাচ্ছে প্রথম আদেশে আদালত সমন ইস্যু করেছে। পরের ধার্য্য তারিখ অর্থাৎ ২৭/৯/২৩ তারিখে সমন জারী হয়ে ফেরত আসে নাই মর্মে বর্ণিত আছে নথিতে।  এক্ষেত্রে আদালতকে সমন জারী হওয়ার জন্য আরো একটি ধার্য্য  তারিখ পর্যন্ত  অপেক্ষা করা প্রয়োজন ছিল। কারন দন্ডবিধির ৩২৩ ধারার বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধিতে লেখা আছে আদালত সমন দেবে। দন্ডবিধি ৩২৩ ধারার বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির সিডিউলে স্পষ্ট লেখা আছে যে আসামিকে আদালত সমন ইসু করবে। ওয়ারেন্টের বিষয়ে কিছু লেখা নেই।

এছাড়া ঐদিন (২৭ শে সেপ্টেম্বর)  বাদী সময়ের প্রার্থনা করেছেন, আদালত সময় মঞ্জুরও করেছেন। যেহেতু বাদী কোর্টে হাজির ছিলনা এবং ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য বাদী পক্ষে কোন আবেদন/ নিবেদন ছিল না, সেক্ষেত্রে সমন জারীর জন্য পরবর্তী একটা তারিখ দিতে পারতো, তা না করে বাদীর প্রার্থনা ছাড়াই সরাসরি ওয়ারেন্ট ইস্যুকরা আইনানুগ হয়েছে কিনা সেটিও ভাবা দরকার।

বিবাদীকে শুধুমাত্র অভিযোগই নয়, সমনও পরিবেশন করতে হবে কারণ এটি হল ‘সমন ‘ যা বিবাদীর উপস্থিতির জন্য আদালতের ক্ষমতাকে মুখ্য করে তোলে। সমনের মাধ্যমেই আসামীকে উপস্থিত হতে বা ডিফল্টের মুখোমুখি হতে “তলব” করা হয়। এক্ষেত্রে নন কগনিজিবল এবং জামিনযোগ্য মামলায় আসামীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে,  সমন জারী হবার পূর্বে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে।

Exit mobile version