Site icon দৈনিক এই বাংলা

বৈধ সোনায় কাস্টমস কমিশনারের ফাঁদ

নাদিরা শিমু :::

চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে প্রবাসী যাত্রীদের আনা বৈধ স্বর্ণের উপর লোলুপ দৃষ্টি থাকে কাস্টম কর্মকর্তাদের। শুল্ক পরিশোধ করে স্বর্ণ বিমানবন্দর দিয়ে বের হবার পরপরই গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ সদস্যদের একটি চক্র এসব বৈধ স্বর্ণ আটক করে জমা দিচ্ছে কাস্টমসে। নানা কূটকৌশল ব্যবহার করে শুল্ক পরিশোধ করে বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  সৌদি আরবে ওমরা করতে গিয়ে বারো যাত্রী শুল্ক পরিশোধ করে বৈধ পথে এনেছিলেন স্বর্ণের অলংকার। সব যাত্রীর বাড়ি চট্টগ্রামের টেকনাফ উপজেলায়। শাহ আমানত বিমানবন্দরে শুল্ক পরিশোধসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে যখন তারা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেবার আগেই  হাঁনা দেয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কনস্টেবল ( এনএসআই)।

নতুন নিয়মে বিদেশ থেকে একজন যাত্রী শুল্ক পরিশোধ করে ১১৭ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণের বার আনতে পারেন। ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা অনুযায়ী আগে একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ২৩৪ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার আনতে পারতেন। আর মহিলারা আনতে পারবেন ১১৭ গ্রাম (১০ ভরি)। এর বেশি আনলে রাষ্ট্রের অনুকূলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। শুধু তাই নয়, ভরিপ্রতি দুই হাজার টাকা শুল্ককর দিয়ে বছরে শুধু একবারই সর্বোচ্চ ২০ ভরি স্বর্ণ বা রুপা আনা যাবে। তবে,  আইনের এসব সীমারেখা শুধু কাগজে কলমে। যাত্রীদের কাছ লুট করা স্বর্ণ, রেয়াজউদ্দিন বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

চলতি বছরের ৮ ই মার্চ,   ওমরা শেষ করে দেশে ফেরা স্বজনদের বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করতে আসা ‘কে এম আজাদ’ নিরাপত্তা খাতিরে ত্রিশ পিস স্বর্ণালংকার (চুড়ি ৭৪৭ গ্রাম ) চারটি স্বর্ণের বার (৪৬৫ গ্রাম)নিজের আয়ত্বে নেন।  এনএসআইয়ের সেই কনস্টেবলের জেরার মুখে শুল্ক পরিশোধের যাবতীয় ডকুমেন্টস প্রদর্শন করার পরও কর্ণপাত করেন নি তিনি। যাত্রীদের সাথেও কোন কথা বলতে নারাজ এনএসআই’য়ের সেই কনস্টেবল।

৮৭ লক্ষ সাতাত্তর হাজার তিন চার টাকা মুল্যের স্বর্ণালংকার ছাড় করতে নগদ পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ চেয়ে বসেন। শুল্ক পরিশোধ করা স্বর্ণের জন্য এতো বড় অংকের ঘুষ দিতে প্রস্তুত ছিলেন না সৌদি ঘেকে ফেরা  যাত্রীরা। কোন দফারফা করতে না পারার কারণে কাস্টমস কর্মকর্তার কাছে তাদের রিসিভ করতে আসা আজাদকে স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বারসহ নিয়ে যান। ভিন্ন বারোজনের নামে শুল্ক পরিশোধ করা হলেও কাস্টমস কর্মকর্তা  ‘ডিএম’ দেখালেন বিমানবন্দরে স্বজনদের রিসিভ করতে আসা  কে এম আজাদের এনআইডির বিপরীতে ( মামলা নং -৬০)। জাতীয় পরিচয় পত্র অনুযায়ী কেএম আজাদের বাড়ি সাতকানিয়া উপর উপজেলার বাবুনগরের খন্দকার বাড়ি।

একে আজাদ জানান, ‘ বিমানবন্দরে আসা নাসির উদ্দীন ও সুমাইয়া নামের দুই আত্নীয়কে রিসিভ করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েছি। আমি বিদেশ ফেরত যাত্রী নই। স্বর্ণ চোরাচালানের সাথেও জড়িত নই। বিমানবন্দরে গিয়ে আমি দেখি আমার আত্নীয়রাসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। ওদেরকে নাস্তা করার জন্য পাঠিয়ে ওদের মালামাল পাহারা দিচ্ছিলাম। তাদের সাথে থাকা স্বর্ণের শুল্ক পরিশোধের কাগজপত্র ছিলো। কিন্তু ঘুষ দিতে রাজী না হবার কারণে বৈধ স্বর্ণ হাতিয়ে আমাকে ঝামেলায় জড়ানো হয়েছে৷  ‘

অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব স্বর্ণালংকারের  প্রকৃত মালিক গাড়িতে থাকার পরও ; ফাঁদে ফেলে আটকে দেয়া হয় বৈধ পথে আনা এসব স্বর্ণালংকার। আর রিসিভ করতে আসা কেএম আজাদকে। ‘ ডিএম ‘নথি অনুযায়ী মার্চ মাসের আট তারিখ এসব স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। কে এম আজাদের নামে ডিএম করে তাকে যাত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ হাতে আসা নথি অনুযায়ী এসব স্বর্ণের অলঙ্কার ও বারের প্রকৃত মালিক সৌদি থেকে।

বিমানবন্দর থেকে অবৈধ স্বর্ণ উদ্ধার করা করা হলে আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করতে হয়। কিন্তু এই চালানের ক্ষেত্রে সেই আইন মানা হয় নি। জব্দ করা স্বর্ণ আটক রেখে একেআজাদকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সুত্রমতে, শুল্ক পরিশোধ করার বৈধ কাগজ থাকার কারণে ফৌজদারি মামলা না করে আভ্যন্তরীণ সমঝোতার পথ তৈরি রেখেছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা৷ ঘুষের ফরমায়েশ পুরন হলেই ছেড়ে দেবে জব্দ করা এসব স্বর্ণ৷

নথি অনুযায়ী,  কেএম আজাদ ন্যায় বিচার চেয়ে আবেদন করেছেন মে মাসে। শুনানির জন্য তাকে ডেকেছে কাস্টমস কর্মকর্তা। শুনানির আড়ালে শুল্ক পরিশোধ করা স্বর্ণের মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ নেবার অভিযোগ কাস্টমস কমিশনার ফায়জুর রহমানের বিরুদ্ধে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে কাস্টমস কমিশনারের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেন নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজার কেন্দ্রীক স্বর্ণ চোরাচালানের বড় একটি অংশই যোগান দিচ্ছে কাস্টমস কর্মকর্তারা। শুল্ক পরিশোধ করা স্বর্ণ শুধু নয়, বিমানবন্দরে ধরা পড়া স্বর্ণের বড় একটি অংশই চোরাকারবারিদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে,  এক বছরে দেশে বিমানযাত্রীদের মাধ্যমে বৈধভাবে ৪৬ লাখ ভরির সমপরিমাণ ৫৪ টন সোনার বার এসেছে। এর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে ঢাকার শাহজালাল এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এই সোনা আসে। আগের বছরের তুলনায় তা ৫৩ শতাংশ বেশি।

সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের অভিযোগ, বৈধ পথে স্বর্ণ আনার পরিমান কমাতে আতন্ক ছড়ানো হয়েছে। শুল্ক পরিশোধ করার পরও কাস্টমস কর্মকর্তাদের সাথে সমঝোতা করা ছাড়া স্বর্ণ বিমানবন্দর দিয়ে বের করা দুষ্কর। তাদের অভিযোগ সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে  বৈধ পথে স্বর্ণের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করছেন ‘ফরিদপুর’ এলাকার কিছু ব্যবসায়ী। অভিযোগ, চট্টগ্রামের  কাস্টমস কমিশনার ফায়জুর রহমানের আত্নীয় স্বজনরা এই রুটে বৈধ অবৈধ স্বর্ণের চালান নিয়ন্ত্রণ করছেন।

এইবাংলা /তুহিন

Exit mobile version