Site icon দৈনিক এই বাংলা

এক ঝুলনে শেষ এলইডি বাতি প্রকল্প

::: নাদিরা শিমু :::

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৪৬৬ কিলোমিটার এলাকা এলইডি বাতির আলোয় আলোকিত হওয়ার কথা থাকলেও ; শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে এই প্রকল্প ডুবিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাস।

অনিয়ম – দূর্নীতি,  প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের অভিলাষের চিপায় পড়ে ভারত সরকারের এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট)  অর্থায়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ২৬০ কোটি টাকার এলইডি বাতি প্রকল্প পার করেছে অনুমোদনের চার বছর সময়। ধবধবে সাদা আলো ছড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়ে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে ডুবছে প্রকল্পটি। চার  বছর পার হয়েছে তবুও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। প্রকল্পের শুরু থেকে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ঝুলন কুমার দাশের নানা জাল-জালিয়াতির প্রমাণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয় নি চসিক।

এই প্রকল্পের দরপত্রের শুরু থেকে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন মানা হয়নি সেটিই শেষ পর্যন্ত জানালো সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট এন্ড টেকনিক্যাল  ইউনিট ( সিপিটিইউ)। গত ১২ ই জুন সিপিটিইউ’র উপ সচিব শাখাওয়াত হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে ‘ প্রকল্প পরিচালকের সরকারি ক্রয় আইন সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। চিঠিতে বলা হয়,   বাংলাদেশ সরকারের প্রচলিত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী (২০০৬) এর ৩(২) ঘ অনুচ্ছেদ  অনুযাযী কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা বাধ্যতামূলক। অথচ  প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাস এর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মন্ত্রানালয়কে   জানিয়েছিলেন কারিগরী প্রস্তাব  মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের  স্বাক্ষর সম্মেলিত মুল্যায়ন  প্রতিবেদন (রেজুলেশন)  তৈরি করা বাধ্যতামূলক নয়। তখন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় এই বিষয়টি সম্পর্কে সিপিটিইউর  মতামত চেয়ে পাঠিয়েছিলেন।

মতামতের এই চিঠি অনুযায়ী পিপিআর ২০০৮ ( পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট) ৮৪ অনুচ্ছেদ এর  (৩) (৪) ( ৫) কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে  এক ধাপ দুই খাম পদ্ধতি অনুযায়ী মুল্যায়ন কমিটির (TEC) সদস্যদের স্বাক্ষর সম্বলিত মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে।

২০২২ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্পটির দরপত্র মুল্যায়নে জালিয়াতির আশ্রয় নেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিদ্যুৎ উপ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী শহীদুল আলম। দরপত্রে অংশ নেওয়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সিগনেচার ইন্ডিয়া লিমিটেড (ফিলিপস) ক্রুটিপুর্ণ মুল্যায়নের (কারিগরি প্রস্তাব)  এবিষয়ে ভারতীয় দূতাবাসে অভিযোগও করেছিলেন।  সূত্রমতে,  চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এই প্রকল্প পরিচালক সিগনেফাই ইনুবিশন ইন্ডিয়া (  ফিলিপস) লিমিটেডের কারিগরী প্রস্তাবে মার্ক দিয়েছেন মাত্র  ৪৭। আর নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠান এসপিএল’কে ৯৭ মার্ক দিয়ে পছন্দের শীর্ষে রাখেন। একই সিন্ডিকেটের  আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইএসএল’কে দ্বিতীয় স্থানে রাখেন তিনি। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি স্মার্ট এলইডি লাইট উৎপাদনই করে না। আর শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেড ( এসপিএল) ভারতের বিচার রাজ্য সরকারের কালো তালিকাভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। এই এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের কারিগরী প্রস্তাবে ‘ওসরাম’ নামের একটি ব্র্যান্ড প্রস্তাব করেছে যেটি এখন চায়না মালিকানাধীন।  অনিয়মের পুরো প্রক্রিয়ায় প্রকল্প পরিচালককে সঙ্গ দিয়েছেন  চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম, তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম। প্রকল্প পরিচালক জুলন কুমার দাস পছন্দের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে একটিকে এই প্রকল্পের কাজ দিতে গিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়েছেন অনিয়মের আশ্রয়। একনেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  অনুমোদিত ব্র্যান্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রকল্প ডিপিপি থেকে।

ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সিগনেচার ইনোভেশন ইন্ডিয়া লিমিটেডের অভিযোগের ভিত্তিতে দরপত্রে অংশ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই কারিগরি প্রস্তাবের জন্য রেসপনসিভ করা হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে আর্থিক  প্রস্তাবনার খাম খুলতে গিয়ে। দেখা যায় প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাস পূর্বের কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়নের কোন রেজুলেশন তৈরি করেননি। এই বিষয়ে সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় প্রকল্প পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চাইলে তিনিও তাদের সাত পাঁচ চৌদ্দে সন্তুষ্ট করতে চান। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় বিষয়টি সুরাহা করতে ‘সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট ‘ মতামত চেয়ে পাঠান। উত্তরে সিপিটিইউ সাফ জানিয়ে দিলো কারিগরী প্রস্তাব মুল্যায়নের প্রতিবেদন তৈরি করা ছাড়া আর্থিক প্রস্তাবনার খাম খোলা আইনসম্মত হবে না।

পক্ষপাতী নাম্বার নিয়ে মুল্যায়ন কমিটির দুই বহি: সদস্যের আপত্তির কারণে জটিলতা তৈরি হয়। নিম্মমানের এলইডি বাতি প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ মার্ক দেওয়া নিয়ে পছন্দের শীর্ষে রাখা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। সেই জটিলতার অবসান ঘটেনি এক বছরেও। অভিযোগ উঠে,  অবৈধ ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে শাফুর্জি পালনজি লিমিটেড ও এনার্জি ইপিসিয়েনসি লিমিটেডের যে কোন একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পাইয়ে দিতে অনিয়মের আশ্রয় নেন ঝুলন কুমার দাশ।

দরপত্রে নজিরবিহীন অনিয়মের আশ্রয় নেয়ার কারণে প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাসের বিরুদ্ধে কি ধরনের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেই সম্পর্কে জানতে চেয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেন নি।

এইবাংলা /হিমেল

Exit mobile version