Site icon দৈনিক এই বাংলা

রেকর্ড লোডশেডিংয়ের কলঙ্ক

::: নিজস্ব প্রতিবেদক :::

বিদ্যুৎ খাতের নানা অনিয়মের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে এবার যুক্ত হলো রেকর্ড পরিমাণ লোডশেডিংয়ের কলঙ্ক তিলক। ২ রা জুন মধ্যরাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমার সাথে পাল্লা দিয়ে সাড়া দেশে বেড়েছে লোডশেডিং। তীব্র তাপদাহের সাথে বিদ্যুৎ না থাকার যন্ত্রণায় কাতর সারা দেশের মানুষ।

এমনিতেই প্রচণ্ড গরমের কারণে ঘরে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে, এর ওপর লোডশেডিংয়ের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় জনদুর্ভোগ চরম আকারে পৌঁছেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গ্রাম-গঞ্জে। গ্রামে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। শহরের আবাসিক ফ্লাটে বিদ্যুত গেলে জেনারেটর কস্ট কিছুটা কমালেও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না সেই সুখকর পরিস্থিতি।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে রামপাল, আশুগঞ্জ নর্থ ও আশুগঞ্জ ইস্ট এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি ত্রুটির কারণে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। এ তিনটি কেন্দ্র থেকে এক হাজার ৪৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো।তবে মন্ত্রণালয়ের দাবি,   উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতির কারণেই  অনাকাঙ্ক্ষিত লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে দেশ।

সুত্রমতে,  ৩ জুন দিবাগত রাত ১২টায় রেকর্ড লোডশেডিং হয়েছিল। ওই সময় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৮১ মেগাওয়াট। আর ৪ জুন রাত ১টায় লোডশেডিং করা হয় তিন হাজার ২৪ মেগাওয়াট।

কয়লা সংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়া  পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এমন পরিস্থিতির কথা বলা হলেও সুত্রমতে দেশে সর্বোচ্চ  উৎপাদনে তথ্যগত অসংগতি রয়েছে। কয়লা সংকটের কারণে গতকাল বেলা সাড়ে ১২টায় বন্ধ হয়ে যায় পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিএমসির যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর এবারই প্রথম পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ হলো। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার আগে জুনেই দেশে দ্বিতীয়বার সর্বোচ্চ লোডশেডিংয়ের রেকর্ড হয়েছে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন , “বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে সরকারের অনুসৃত ভুল নীতি ও দুর্নীতি, বিদ্যুৎ খাতকে বর্তমান সংকটের মুখে ফেলেছে।”

সূত্রমতে, সোমবার (৫ জুন) মধ্যরাতে লোডশেডিংয়ের নতুন রেকর্ড হয় রাত ১টায়। ওই সময় তিন হাজার ২১৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। আর রাত ২টায় লোডশেডিং করা হয় তিন হাজার ১৪৩ মেগাওয়াট। এরপর লোডশেডিং কিছুটা কমলেও সোমবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত উচ্চ হারে লোডশেডিং অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে সকাল ১০টায় ও বিকাল ৪টায় দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। বাকিটা সময়ও লোডশেডিং আড়াই হাজার মেগাওয়াটের নিচে নামেনি।

সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যানুযায়ী  পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রকে এরআগে ছয় মাস বাকিতে কয়লা দিয়েছিলেন সিএমসি। পরে আরও তিন মাসের বকেয়াসহ ৯ মাসে এই বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯৮ মিলিয়ন (২৯.৮ কোটি) ডলার। তীব্র ডলার সংকটের কারনে কয়লা আমদানির প্রয়োজনীয় এলসির জন্য ডলারের যোগান দেয়া যায় নি। জুন মাসে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ খাতে লোডশেডিং ও কয়লার সংকট প্রকাশ পেলেও এপ্রিল মাসে তেমন আশংকার কারণে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছিলো সিএমসি। কিন্তু চাহিদামতো ডলার পায়নি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)।

মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে,এ পর্যন্ত মাত্র ৮৮ মিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করতে মাসে গড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন কয়লা প্রয়োজন । কিন্তু ডলার সংকটে কয়লা সরবরাহের জন্য এলসি খুলতে পারছিল না চীনের সিএমসি। তবে এরই মধ্যে এলসি খোলা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহের জন্য। চলতি মাসের শেষ দিকে এ কয়লা দেশে এসে পৌঁছাতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ার কারণে এমন সংকটের সৃস্টি।  সরকারের তরফ থেকে বেশ কিছুদিন ধরে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার প্রচারণা চালানো হলেও নিম্ন মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের দেশে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিপর্যায়ের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সুযোগটা একবারেই সীমিত।

জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ৫১২ কিলোওয়াট। ভারত মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের এই ধাপ অতিক্রম করেছে ২০ বছর আগে। ভারতের বর্তমান মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ কিলোওয়াট। বাংলাদেশের মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার ভারতের গড় ব্যবহারের ৪০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক গড়ের মাত্র ১৭ শতাংশ।

 

এইবাংলা/ হিমেল

Exit mobile version