Site icon দৈনিক এই বাংলা

বিএম ডিপু ট্রাজেডির এক বছর আজ

::: ইদ্রিস মিয়াজি, চট্টগ্রাম ::

গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ৫১ জন নিহত হয়।  এ ঘটনায় আহত হন পাঁচ শতাধিক। ডিপোর একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দুর্ঘটনায় রফতানি পণ্যবাহী ১৫৪ কনটেইনার এবং আমদানি পণ্যবাহী দুটি কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগুনে পোড়া বিএম কনটেইনার ডিপোর ধ্বংসস্তূপে মানুষের হাড়, মরদেহের বিভীষিকাময় স্মৃতিবিজড়িত সেই জায়গায় সব কিছু আগের মতো স্বাভাবিক , কিন্তু এক বছরেও থামেনি স্বজন হারানোর কান্না।   সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিভীষিকাময় বিস্ফোরণের এক বছর পুর্তি আজ।

এই ঘটনার এক বছর হলেও সবকটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে  এমন বিভীষিকাকে দূর্ঘটনার খামে বন্ধ করা হয়েছে। প্রকৃত কারণ উদঘাটন যেমন হয় নি, তেমনিভাবে বিচার পায় নি ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। বিস্ফোরণের পর পুলিশ বাদী মামলায়  নামীয় আসামি বা কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেওয়া হয়েছে। আহতদের অনেকে এখনও ক্ষতিপুরণ পাননি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এতকিছুর পরও  ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেই বিএম কনটেইনার  ডিপু। পুরোনো ধারায় সচল হয়েছে ডিপোর ব্যবস্থাপনা। সময়ের সাথে চাপা পড়েছে হতাহত পরিবারগুলোর দীর্ঘশ্বাস- কান্না।

অজানাই রয়েছে ৮ জন লাশের পরিচয়:

বিএম ডিপোর বিভীষিকাময় বিস্ফোরণের এক বছরেও অনেকের পরিচয় শনাক্ত করা যায় নি। যে বিস্ফোরণে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল বিএম কন্টেইনার ডিপো; যেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ ৫১ জনের করুণ মৃত্যু এবং চার শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।৫১ লাশের মধ্যে অন্তত ৮ জনের মরদেহ শেষ পর্যন্ত নাম-পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এমনকি এসব মরদেহের কোনো স্বজন দাবিদারও পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশগুলো পড়ে থাকার পর গত ২০ এপ্রিল আদালতের নির্দেশে নগরীর বাইশ মহল্লা কবর স্থানে মরদেহ দাফন করা হয়েছে।

ঘটনার প্রায় এক বছর হতে চললেও এখনও স্বজন হারা পরিবারগুলোর কান্না থামেনি। কর্মক্ষম স্বজনকে হারিয়ে অনেক পরিবার এখন দিশাহারা। নিহতদের পরিবারগুলো কিছু টাকা পেলেও দগ্ধ আহত অনেকেই সেভাবে ক্ষতিপুরণ পাননি। বরং পঙ্গু বা ক্ষত জীবন নিয়ে ভয়াবহ দুর্দশায় কাটছে তাদের জীবন-সংসার। ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের নেপথ্যে মালিক কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট অবহেলা দেখেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু ডিপো মালিকের প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে নত হয়েছে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি।

এমন বিষ্ফোরনে হতাহতদের স্বজন, স্থানীয়রা- শুরু থেকেই ডিপো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে অভিন্ন অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েই
কর্তপক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে মামলা করে স্থানীয় পুলিশ। যেখানে পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় স্পস্ট সুযোগ দেখেছিলেন আইনজীবীরা, সেখানে পুলিশ বাদী হয়ে (অবহেলাজনিত মৃত্যু) দিয়ে মামলা করে। সেখানেও যাদেরকে (আজ) আসামি করা বিএম ডিপোর মধ্যম বা নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা মাত্র। যাদের হাতে ডিপোর কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব থাকলেও প্রতিষ্ঠানের ‘সেফটি- সিকিউরিটি ক্ষমতা ছিল । অতঃপর সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর আট কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দাখিল করে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম জেলা ডিবি পুলিশ বলেছে, ‘অভিযুক্তরা ঘটনার জন্য দায়ী না,  বিস্ফোরণটি কোনো নাশকতা।

কর্তৃপক্ষের দায়মুক্তির “ফাইনাল রিপোর্ট”

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল। সীতাকুণ্ড মডেল থানার সূত্রে জানা যায়, পুলিশ বিএম ডিপোর বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তবে আদালতে এখনও শুনানি হয়নি।’

বিএম ডিপোর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়  বর্তমানে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অংশিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে।এদিকে, ঘটনার প্রায় এক বছর পুর্ণ হলেও নিহত ও আহতদের পরিবারগুলোর কান্না আহাজারি এখন থামেনি। বিএম ডিপোর সেই বিস্ফোরণে নিহতের স্বজনের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তিনি বলেন, সন্তানকে হারিয়েছি। বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম। কিন্তু টাকা কেন, কোনো কিছুর বিনিময়ে তো আর তাকে ফিরে পাব না। ছেলেরে হারিয়ে আমরা মানসিকভাবে শেষ হয়ে গেছি। ‘

কর্তৃপক্ষের দায় বা অবহেলা  সম্পর্কে জানতে চাইলে নিহতের স্বজন বলেন, কাকে দায়ী করব। পুলিশ তো ফাইনাল রিপোর্ট দিল।

বিএম ডিপো ফের সচল :

ডিপো সংস্কার করার পর গত ২২ আগস্ট শুধু খালি কন্টেইনার সংরক্ষণের অনুমোদন দেয় কাস্টমস বিভাগ। তবে শর্ত মানায় গত ৭ নভেম্বর আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম পুরোদমে শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমানে সার্বিকভাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিক্রম কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ।

ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় যেভাবে :

পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে  যায়, ক্ষতিগ্রস্ত ৬৯ জনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৬ জন নিহত রয়েছেন। এ তালিকায় ১৩ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী ১ জন কর্মচারী এবং অন্যান্য ও সার্ভিসের নিহতদের ১৫ লাখ, বিএম ডিপোতে কর্মরত ও সাধারণ নিহতদের ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় যাদের অঙ্গহানি হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী হলে ১০ লাখ, বিএম ডিপো ও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ৬ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয় প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা গেছে।

এজাহারে যা বলা হয়েছিল জুন সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ বাদী হয়ে বিএম ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করে।

পুলিশ এজাহারে বলেছে, “বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কন্টেইনারের ভেতর কেমিক্যাল ভর্তি ড্রাম থাকার বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। আসামিদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে বিএম ডিপোতে অগ্নিকান্ডও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এ মামলায় মালিকপক্ষের কাউকই  আসামি করা হয় নি। মামলায় আসামী করা হয়  বিএম ডিপোর ডিভিএম (অপারেশন) নুরুল আক্তার, ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (অ্যাডমিন অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স) মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কলোইনার ডিপো-আইসিডি) আবদুল আজিজ, সিএনএস ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশনের (সিএফএস) কর্মী নজরুল ইসলাম এবং জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) আক্তার খানকে।

বিশ্লেষকদের মতে, কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ দূর্ঘটনাটির স্বরুপ উদঘাটন করতে প্রশাসনের স্বদিচ্ছার অভাব ছিলো। মালিক পক্ষের অবহেলার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণ হবার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয় নি।

 

এইবাংলা /তুহিন

Exit mobile version