22 C
Dhaka
Thursday, February 13, 2025
More

    প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার টাকা বানানোর মেশিন

    আরও পড়ুন

    খান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ , চট্টগ্রাম ::

    চট্টগ্রামের পোর্ট এক্সেস সড়কে ও এন্ড এম পদ্ধতিতে টোল আদায়ের নিয়ম থাকলেও অভিনব কায়দায় লুটপাট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায়ের সুযোগ দিয়ে অন্তত সাড়ে চার কোটি টাকা লুটপাটের রাস্তা করে দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা। তার বিরুদ্ধে এমন লুটপাটের অভিযোগ জমা পড়েছে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর এর প্রধান প্রকৌশলী বরাবর।

    জনৈক কারিউল মওলা স্বাক্ষরিত অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের পোর্ট এক্সেস রোডের টোল আদায়ে, দৈনিক ১,২০,০০০ (এক লক্ষ বিশ হাজার )করে ১ বছরে চার কোটি আটত্রিশ লক্ষ টাকা রাজস্ব হারাইছে সরকার। অভিযোগকারী তার অভিযোগে পুরো প্রক্রিয়ার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমাকে দায়ি করেছেন । চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে ভাড়াটে টোল আদায়কারীরা নানা কৌশলে টোলের সিংহভাগ টাকা রাজস্ব খাতে জমা না দিয়ে নিজেদের পকেট ভর্তি করে আসছেন এক  বছরের বেশি সময় ধরে। জবাবদিহিতা না থাকার কারনে টোল আদায় খাতে বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকর। সুত্রমতে  গত কয়েক বছরে প্রকৃত অংক অতিরিক্ত  অন্তত সাড়ে চার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।এই বিষয়ে   কারিউল মওলা লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর এর প্রধান প্রকৌশলীর নিকট। যার অনুলিপি সড়ক ও সেতু মন্ত্রী এবং সচিব বরাবরে দেওয়া হয়েছে।

    অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগ তার অধিনস্স্থ চট্টগ্রাম পোর্ট এক্সেস রোডের মাশুল আদায় কার্যক্রমে সংস্থাটির  কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ না করে নির্বাহি প্রকৌশলী তার নিজস্ব লোক দিয়ে টোল আদায় করছেন।মাশুল আদায় কার্যক্রম এর সাথে যাদেরকে নিয়োজিত করা হয়েছে তাদের বৈধ কোন সরকারি আদেশও নাই । এমন কি কাগজে কলমে টোল  আদায়ের সাথে জড়িত লোকবলের কোন প্রকার বেতন ভাতাও সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে প্রদান করা হয় না। সরকারের রাজস্বের মত স্পর্শকাতর একটি যায়গায় কোন প্রকার জামানত বিহীন অবৈধভাবে লোক নিয়োগ করা করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

    সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যে সকল গাড়ি থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে টোল আদায়ের রশিদও। দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা যায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে তাদের টোল আদায়ের কাজ দেয়া হয়েছে। তারা সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মচারী কিনা এমন প্রশ্নে ভড়কে যান সুপারভাইজার পরিচয় দেয়া সাদ্দাম হোসেন। প্রতিবেদককে পরামর্শ দেন তদারকির দায়িত্ব নিয়োজিত সড়ক ও জনপদের প্রকৌশলীর সাথে কথা বলার জন্য। ফয়সল নামের সেই  প্রকৌশলীর সাথে কথা বলে জানা যায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা সবকিছু জানেন। টোল আদায়ের জন্য ইউডিসি-ভান নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

    সড়ক ও জনপথ বিভাগ এর তথ্যমতে, চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের অধীন পোর্ট এক্সেস রোডের টোল আদায়ের কার্যক্রম ওএন্ডএম (অপারেশন এন্ড মেন্টেইনেন্স) পদ্ধতিতে টোল আদায় করার জন্য ২০১৮ সালে ইউডিসি ভান নামের প্রতিষ্ঠানকে টোল আদায়ের অপারেটর নিয়োগ দেয়া হয়, সেই বৈধ মেয়াদও ২০২২ সালের ২৪ শে মার্চ  হয়েছে।  বর্তমানে কাগজে কলমে মাশুল আদায় করছে সড়ক বিভাগ চট্টগ্রাম, এমন তথ্য দেয়া হলেও  বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

    অভিযোগকারী তার অভিযোগ পত্রে বলেন  চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা কৌশলে  পুরো বিষয়টি আড়াল করে নিজের পছন্দের জনবল দিয়ে টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রায় এক বছর এর অধিক সময় ধরে। ফলে সরকার প্রকৃত  টোল আদায়ের পরিমান থেকে বিপুল অংকের রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রকৃত আদায়কৃত টোল থেকে প্রতিদিন এক লাখ বিশ হাজার টাকা বছরে ৪ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

    তবে অনুসন্ধানে জানা যায় দৈনিক লুটপাট হওয়া অংকের পরিমান অন্তত তিন লাখ টাকা। বেসরকারি একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে প্রতিদিন নূন্যতম গড়ে সাত থেকে আট হাজার  গাড়ি এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করে, এর  বেশিরভাগই ট্যাঙ্কার, লরী, কাভারভ্যান, ট্রাক, পিকাপ। সেই হিসেবে এই টোল হতে দৈনিক আদায়কৃত মাশুলের পরিমাণ আনুমানিক ৩ লক্ষাধিক টাকার বেশি হলেও কার্যত গড়ে আশি হাজার টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অন্তত তিন লাখ টাকা ।

    বর্তমানে পোর্ট কানেটিং রোডে টোল আদায়ের পর অর্থ সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছেন সড়ক ও প্রকৌশল বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী ফয়সল আবদুল্লাহ । আর টোল আদায়ের কাজে নিয়োজিত রয়েছে পূর্বের ঠিকাদারের কর্মচারীরাই।  বর্তমানে এই টোল প্লাজায় ১৬ জন লোক কর্মরত রয়েছেন। এই ১৬ জন লোকের বেতন-ভাতা কিভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে – এমন প্রশ্নের কোন উত্তর মেলেনি৷

    অপারেশন এবং ম্যানটেইনাস সিস্টেম অনুযায়ী সর্বনিম্ম দরদাতাকে বৈধভাবে অপারেটর নিয়োগ দেবার নিয়ম থাকলেও সেটি না মেনে পছন্দের লোক দিয়ে টোল আদায় করছে পিন্টু চাকমা। 

    চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘ মাস্টার রোলে কর্মচারীদের বেতন দেয়া হচ্ছে। বর্তামানে টোল আদায় করা হচ্ছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। মন্ত্রণালয়ের নতুন টেন্ডারে প্রক্রিয়া চলছে৷ ‘

    সংশ্লিষ্ট সুত্রমতে, ইজারা নেবার প্রক্রিয়ায় বড় অংকের নিরাপত্তা জামানত জমা রাখতে হয়। এখন কোন ধরনের নিরাপত্তা জামানত ছাড়াই নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার সাথে চুক্তি করে ( ব্যক্তিগত) নিজের লোকজন দিয়ে টোল আদায় করে গড়পাত্তা টাকা সড়ক ও জনপথ বিভাগে জমা দিচ্ছেন। সুত্রমতে, আদায়কৃত টোলের বড় অংশই যাচ্ছে নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার পকেটে।

    সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে,২০১৪ সালের টোল নীতিমালার ১৪ ধারা অনুযায়ী  সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে টোল আদায়ের পদ্ধতি থাকলেও টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই নীতিমালাকে । নীতিমালার তোয়াক্কা না করে নিজের পছন্দের লোকবল দিয়ে টোল আদায়ের  কার্যক্রম চলাচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা । 

    জানা যায়,  চারবছর বিরতি দিয়ে ২০১৮ সালে ইউডিসি ভান নামের প্রতিষ্ঠানকে টোল আদায়ের ইজারা দেয়া হয়, সেই বৈধ মেয়াদও ২০২২ সালে শেষ হয়েছে।  কাগজে কলমে মাশুল আদায় করছে সড়ক বিভাগ চট্টগ্রাম, এমন তথ্য দেয়া হলেও  বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

    সরেজমিনে টোল প্লাজা গিয়ে কথা হয় কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার সাদ্দাম হোসেনের সাথে। পিন্টু চাকমার পক্ষ থেকে টোল আদায়ের বিষয়ে  তিনিই তদারকি করছেন। দেনিক ৫০০ টাকা বেতন নির্ধারন করা আছে তার। সাদ্দাম জানান, আদায়কৃত টোল থেকে গত তিন মাসে দেনিক  গড়ে ৭২ হাজার থেকে ৯৫ হাজার পর্যন্ত রাজস্ব জমা করা হয়েছে। 

    পোর্ট এক্সেস রোড় টোল প্লাজা

     

    এভাবে সড়ক ও জনপদ বিভাগের নাম ভাঙ্গিয়ে বছর বছর হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ৷এরআগে একই নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার সহযোগিতায় কাজ শুরু না করেই দুইটি প্রকল্প প্রায় চার কোটি টাকা তুলে নেয় দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এমন অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হলেও পার পেয়ে জান তিনি। অভিযোগ পত্রে বলা হয়, পিন্টু চাকমার ঘনিষ্ঠ লোক আনিসুর রহমানকে (হাসান টেকনো বিল্ডার্স) এবং কাজল এন্ড ব্রাদাসকে তিনটি কাজের অনুকুলে প্রায় চার কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। আনিসের হাসান টেকনো বিল্ডার্সকে ২ কোটি ষাট লাখ টাকার কাজ দেয়া হয় ( আইডি- ৬৩৬৭৬৭), কাজ না করলেও প্রতিষ্ঠানটিকে ৫৭,৭২,৫৮০ টাকা বিল প্রদান করেছেন পিন্টু চাকমা । এছাড়া কাজল এন্ড ব্রাদাসকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় একটি বক্স কালভার্টের কাজ দেয়া হয় ( টেন্ডার আইডি-৬৬৮৮০২) ; কাজ শুরু না করেই পুরো তিন কোটি টাকা তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। হাসান টেকনো বিল্ডার্সকে অন্য একটি চব্বিশ লাখ টাকার একটি কাজে (টেন্ডার আইডি-৭০২৪০৩) ১৫ লক্ষ টাকা বিল পরিশোধের পর জানাজানি হয়, প্রতিষ্ঠানটি কোন কাজই করে নি সেই প্রকল্পে। এমন অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ার পরে লোক দেখানে কাজ করিয়ে নেয়া হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দুটিকে দিয়ে।

    টোল প্লাজার টোল আদায়ে অনিয়ম এবং দুটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ না করার পরও বিল পরিশোধ করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার সাথে দ্বিতীয় দফায়  যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেন নি।

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর