ওয়াহিদ জামান ::
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা এবং করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক ঝড়ঝাপটা পৃথিবীর প্রতিটি দেশকেই মোকাবেলা করতে হয়েছে । আমদানি নির্ভর দেশ হিসেবে দ্রব্যমুল্যের উর্ধগতির সাথে ডলার সংকট গলার কাটা হিসেবে বিধেছে বাংলাদেশের । বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেকটা বাধ্য হয়েই আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছিল বাংলাদেশ । যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে গেল সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী ও পরিচালনা পর্ষদে পাস হয় বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব। এই ঋণ প্রস্তাব পাশ হবার কারণে বাংলাদেশ পাচ্ছে সাড়ে তিন বছরের জন্য ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। মোট সাত কিস্তিতে প্রতিশ্রুত অর্থের প্রথম কিস্তি ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার গত সপ্তাহের বুধবার ছাড় করা হয়েছে । বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্রান্তিকালে আইএমএফ এ ঋণ দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর কারণে তীব্র ডলার সংকটে থাকা বাংলাদেশ দম পেলেও এই অর্থ দেশের সংকটাপন্ন অর্থনীতিতে কতোটা স্বস্তি ফেরাবে -এমন নানামুখী বিশ্লেষণ করছেন বিশ্লেষকরা। প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি যোগ করলে আগামী এক বছরে আইএমএফ থেকে পাওয়া যাবে ১০০ কোটি ডলারের মতো।
আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ বাংলাদেশ ৩৩০ কোটি ডলার পাবে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় গঠিত আইএমএফের রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) থেকে বাংলাদেশ পাবে আরও ১৪০ কোটি ডলার। বৈশ্বিক মন্দার এই সময়ে এশিয়ায় আরএসএফ তহবিল থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই অর্থ কতোটা কাজে লাগাতে পারবে সেটি নিয়ে সংশয় রয়েছে । বলা হচ্ছে ৪২ মাসে এ ঋণ ছাড় করা হবে। প্রথম কিস্তিটি অবশ্য ইতিমধ্যে ছাড় করা হয়েছে ।
করোনাকালে সারাবিশ্ব একপ্রকার স্থবির ছিলো । সেই সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সমগ্র পৃথিবীর অর্থনীতির উপর । একাধারে তিনবছর এমন চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোরও । ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশ । তিন বছর ধরেই বৈশ্বিক দুই বড় ঘটনার প্রভাবে টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে দেশের অর্থনীতি। ইউক্রেনের যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে জীবনধারণের ব্যয় শুধু বাড়ায়নি , বরং বাংলাদেশের। কমে যায় প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)। তার ওপরে আছে অভ্যন্তরীণ কারণ। ঠিক সময়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশের মতো আমদানি নির্ভর দেশে তীব্র ডলার সংকট সৃস্টি করেছে । সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় এই মুহুর্তের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। আমদানি ব্যয়ের মিটার ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালে বেড়ে দাড়িয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে ।ফলে ডলারের দামই শুধু বাড়েনি, তৈরি হয়েছে তীব্র ডলারের সংকট। ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য এলসি খুলতে ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছেন । পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গেলে ফিরিয়ে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানির দায় হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার । এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা এখন বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ করা আছে। বাকি ডলার রপ্তানিকারকের আয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে।
পোষাক রপ্তানীর সাথে জড়িত কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায় , নতুন রপ্তানির অর্ডার কম আসায় মাস্টার এলসি’র বিপরীতে কাঁচামাল আমদানির ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা কমে গেছে। প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করতে না পারায় কাঁচামাল আমদানি নির্ভর শিল্পগুলো এলসি খুলতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতাও কমে গেছে। এই প্রভাব পড়েছে দেশের রপ্তানী আয়ও ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুত্রমতে, ডলার সংকট মোকাবিলায় অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার থেকে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে আমদানিতে লাগাম টানার কথা বলা হলেও পরিস্থিতি ভিন্ন। বর্তমানে ডলার সংকট এতটাই প্রকট হয়েছে যে, উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা ডলার আয় করে না, তারা এখন কোনো এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানির জন্য নগদ টাকায় শতভাগ মার্জিন দিয়েও এলসি খোলা যাচ্ছে না শুধু ডলারের অভাবে। গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে ভোগ্যপণ্যের বাজার। জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৭৪ ডলার থেকে ১২০ ডলারে পৌঁছে যায়। এ কারণে বাংলাদেশেও বাড়াতে হয় জ্বালানি তেলের দাম, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনুল ইসলাম বলেন, বৃহৎ অর্থে প্রতিটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখন গভীর সংকটে পড়েছে । ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে এ সংকট আরও বাড়তে পারে। সাময়িক স্বস্তি দিলেও সংকটের গভীরতা এত বেশি যে আইএমএফের এ ঋণে তা মেটানো কঠিন। তবে আশার কথা প্রায় এক মিলিয়ন লোক গত অর্থবছরে বিদেশে গিয়েছে। তেলের মন্দায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি যখন চাঙ্গা তখন আরও লোক সামনে যাবে। প্রবাসী আয় যা আসছে তা হয়তো দেড় গুণ করা সম্ভব, যদি আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ আনার পথ বের করা যায়। আর্থিক সংকট কাটাতেঋণ দরকার, তার চেয়েও বেশি দরকার অর্থনৈতিক সংস্কার। দুঃখজনক হচ্ছে দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থে যে সংস্কার নিজেদেরই করার কথা, তা করতে হচ্ছে আইএমএফের কথায়।
ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কারের চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সবচেয়ে বড় শর্ত হলো, আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। এ জন্য আগামী বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বলা যায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এটি সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশকে এমন শর্ত চাপিয়ে দিলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন জিডিপি আর কর পরিপুরক একটি বিষয় । করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে একই সময়ে ভালো জিডিপির প্রত্যাশা অনেকটাই দুরহ ব্যাপার । আইএমএফের যুক্তি পৃথিবীর যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম, বাংলাদেশ তার একটি। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা গেলে ভালো ফল আসতে পারে । অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়া ও সুস্ঠু ঋণ ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিবছর সরকারের ঋণ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রে দেশের আর্থিক খাত ও সরকার বড় ধরনের চাপে পড়বে।বিশ্লেষকদের মতে , বর্তমানে দেশের রাজস্ব বিভাগ যে কর আদায় করছে সেটির সাথে জিডিপির ব্যবধান রয়েছে । চলতি অর্থবছরে সরকারের যে ব্যয় হচ্ছে সে তুলনায় রাজস্ব আয় হচ্ছে না। ফলে বাড়তি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে ঋণ করতে হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নানা সংকটে পড়ে তারল্য ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনা বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া আমানত কমায় তারল্যের ওপর চাপ বেড়েছে। সরকারের রাজস্ব আয় ২০২১ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেড়েছিল ১৬ শতাংশ। ২০২২ সালের সময়ে বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে। গেল দুই বছর জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে দুর্বলতা ফুটে উঠেছে ।দূর্বলতা কাটানোর পাশাপাশি আগামী কয়েক বছর বাড়তি ২০ হাজার কোটি টাকার মতো শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। এটি দেশের ব্যবসায়ী শ্রেণীর উপর কি ধরনের প্রভাব ফেলে সেটিও ভাবার বিষয় রয়েছে ।
‘তবে নানান চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছুটা আশার দিক ফুটে উঠেছে । দেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ একটি ইতিবাচক দিক । এখন আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য ইউরোপ এবং নর্থ আমেরিকার কনসিউমারদের বেসিক নিডসের মধ্যে যোগ হয়েছে। ‘
গত অর্থবছরে বাজারকে সহযোগিতা করতে গিয়ে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিক্রির রেকর্ড গড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এভাবে ডলার বিক্রি করার কারণ রিজার্ভ আরও নাজুক পড়েছে এমন অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
আইএমএফের ঋণের সুসম ব্যবস্থাপনাটিও জরুরী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা । বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে , গত এক বছরে সরকারের নেওয়া বিদেশী ঋণে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ঋণ নিয়েছে। টাকার অংকে যা প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা। (এক ডলার ৯৫ টাকা হিসেবে) এর আগে এক অর্থ বছরে কখনও বিদেশ থেকে এত পরিমাণে ঋণ নেয় নি বাংলাদেশ। বর্তমানে ডলারের মুল্য সেই অংকে আরও বেশি । দাতা সংস্থাগুলির মধ্যে বাংলাদেশকে সর্বাধিক ঋণ দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) , এই পরিমান আড়াই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
ফলে টাকার দরপতনের কারণে বিদেশি ঋণের বোঝা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। মোটা দাগে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত শোধ করতে হবে। মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৫০০ কোটি (৯৫ বিলিয়ন) ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ সাত হাজার কোটি (৭০ বিলয়ন) ডলার। আর বেসরকারি খাতে ঋণ ২ হাজার ৫০০ কোটি (২৫ বিলিয়ন) ডলার। ৫ বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে এটি অবশ্যই ভয়ের কারণ হতে পারে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৮১ কোটি (৪৫.৮১ বিলিয়ন) ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই ঋণের অংক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫.৮৬ বিলিয়ন ডলারে । গত দশ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঋণের পরিমান বেড়েছে তিনগুনের বেশি । বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে , ২০২০ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের মজুদ ছিল ৭৩.৫০ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফকে হিসেবে যোগ করলেই ঋণের অংক যেভাবে বাড়বে দেশের জিডিপি তার বিপরীতে কতখানী উর্ধমুখী হয় সেটির উপরই স্বস্তির পারদ উঠানামা করা উচিত বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা ।