18 C
Dhaka
Sunday, February 16, 2025
More

    কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পের দুর্নীতি, কি চায় দুদক?

    আরও পড়ুন

    নাদিরা শিমু, নেওয়াজ তুহিন ::

    কক্সবাজার পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পে প্রতাপশালী মহলের চাঞ্চল্যকর দূর্নীতি প্রকাশ্যে আসে দূর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে। কক্সবাজারের পৌর মেয়রসহ বেশ কয়েজন সরকারি আমলার নাম উঠে আসে তদন্ত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ও আকবর আলীর দেয়া প্রতিবেদনে। প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন উপ সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয় অনুসন্ধানের মাঝপথে। পরবর্তী তদন্তকারী কর্মকর্তা আলী আকবরও তদন্তে ৩৬ কোটি টাকার দূর্নীতির সত্যতা পান। পরের তদন্তকারী কর্মকর্তা নুরজাহান তদন্তে অপারগতা প্রকাশ করার পর এবার আলোচিত সেই পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতি অনুসন্ধানে চতুর্থবারের মতো কর্মকর্তা বদল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল হককে।

    প্রকল্পটিতে দুর্নীতি অনুসন্ধানে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, তার ছেলে, স্ত্রী, স্ত্রীর বড় ভাই এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসামি করার সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন অনুসন্ধান কর্মকর্তা এবং দুদকের উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন। দীর্ঘদিন অনুসন্ধানের পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমোদন চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদনও দাখিল করেছিলেন শরীফ উদ্দিন। তবে ২০২১ সালের সেই অনুসন্ধান প্রত্যাখ্যান করে দুদক। এরপর আকষ্মিকভাবে দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে শরীফকে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়। এমন আলোচিত দূর্নীতি উম্মোচন করার পরও গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। শরীফকে চাকুরীচ্যুত করার পর দেশব্যাপী সমালোচনার জন্ম দেয়। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করায় চাকরি হারাতে হয়েছে তাকে -এমন ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারন মানুষের মনে। শরীফ উদ্দিন তার চাকরি ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে আপিল করলেও বিষয়টি এখনও সুরাহ হয় নি ।

    শরীফ ও আলী আকবরের প্রতিবেদনে যাদের আসামি করার সুপারিশ করা হয়েছিল তারা হলেন-কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি), কক্সবাজার ভূমি অফিসের সাবেক কানুনগো বাচ্চু মনি চাকমা, সাবেক ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা মিজবাহ উদ্দিন, কক্সবাজার সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার রাশেদুল ইসলাম, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব (সাময়িক বরখাস্ত) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নাজিম উদ্দিন, উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো বসন্ত কুমার চাকমা, ইউনিয়ন সহকারী কর্মকর্তা মো. সাহেদ ও আবুল হোছাইন, ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা মো. সৈয়দ নূর, উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ডকিপার জসীম উদ্দিন, সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম, ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা মো. জায়েদ হোসাইন, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মু. শাহরিয়ার মুক্তার, সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) মো. ইসহাক, কক্সবাজার পৌরসভার সচিব রাছেল চৌধুরী, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. শামীম হুসাইন, একই শাখার অতিরিক্ত কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান, কানুনগো মো. নুরুল ইসলাম, সার্ভেয়ার মো. জিয়াউর রহমান, সার্ভেয়ার মো. সাইফুল ইসলাম, সার্ভেয়ার আইএম আশরাফুজ্জামান, মেয়রের স্ত্রী ফারহানা আক্তার, মেয়রের স্ত্রীর ভাই মিজানুর রহমান, কক্সবাজারের বাসিন্দা মমতাজুল ইসলাম, মো. মফিজুর রহমান, মাহবুবুর রহমান, খোরশেদা বেগম, সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মোস্তাক আহমেদ, মোছাম্মৎ মাহমুদা খাতুন, রেজাউল করিম, মোজাফফর আলী, মো. সালাহউদ্দিন ও হাসান মেহেদী রহমান।

    কক্সবাজার পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পে নজিরবিহীন দূর্নীতি প্রমাণিত হবার পরও শরীফের অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নূরজাহান পারভীনকে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। তখন তিনি এই বিষয়ে অনুসন্ধানে অপারগতা প্রকাশ করেন। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় উপপরিচালক আলী আকবরকে। অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানে দালিলিক ও সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় ৩৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়। শরীফের প্রতিবেদনের মতো আলী আকবর প্রতিবেদনেও মেয়র মুজিবুর রহমান, তার পরিবার এবং জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের নাম উঠে আসে। সেই প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করে এবার নতুন করে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হলো উপপরিচালক সিরাজুল হককে। বিশ্লেষকরা বলছেন বারবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনের লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি পাশাপাশি সংস্থাটির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে ।
    দুদক কার্যালয়ের সুত্রমতে, আলী আকবরের প্রতিবেদন গ্রহণ না করে কমিশন অনুসন্ধানের বিষয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদল করেছে। দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল হককে নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অবশ্য সিরাজুল হক এই বিষয়ে কোন কিছু জানাতে রাজি হননি।

    চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা আলী আকবর কয়েক মাস অনুসন্ধান করে ২০২২ সালের ১২ মে শরীফের মতোই কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার এবং জেলা প্রশাসকসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তার অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সরওয়ার কামাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পের জন্য বাঁকখালী নদীর উত্তরপাড়ে ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা মূল্যের জমি অধিগ্রহণের জন্য বাছাই করেন। তার দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর নতুন মেয়রের দায়িত্ব পান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। এরপর প্রকল্পের জন্য আগের প্রস্তাবিত জমি পরিবর্তন করে বেশি দামের বাঁকখালী নদীর দক্ষিণপাড়ে ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা মূল্যের জমি বাছাই করেন। নতুন করে বাছাই করা জমির মধ্যে বেশির ভাগ জমি ছিল মামলার কারণে সরকারি রিসিভারে থাকা। জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। আর কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার।

    সরকারি রিসিভারের জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন হিসেবে রূপান্তরে মেয়রকে সহায়তা করেন কক্সবাজার সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মোক্তারসহ তিন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও জেলার বিভিন্ন পদের তৎকালীন কর্মকর্তারা।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৮ মে প্রস্তাবিত বাঁকখালী নদীর উত্তরপাড়ের জমি গ্রহণ না করে সরকারি অর্থের অপচয়, কারচুপি ও আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বাঁকখালী নদীর দক্ষিণপাড়ে ১০ গুণ বেশি মূল্যের জমিতে প্রকল্প নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। উচ্চমুল্যে জমি ক্রয় করে সরকারী অর্থ লোপাটের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবার পরও প্রতাপশালীদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয় নি সরকার ।

    অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ভূমি বরাদ্দ কমিটির বৈঠকে ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। প্রকল্পের জন্য বাছাই করা জমির ২ দশমিক ১৯ একরের মধ্যে ১ দশমিক ৭২ একর জমি কক্সবাজার পৌরসভার ও আওয়ামী লীগ নেতা মেয়র মুজিবুর রহমান পূর্বপরিকল্পিতভাবে আদালতের রিসিভার থাকা সরকারি জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন দেখান। মেয়রের স্ত্রী ফারহানা আক্তার ও স্ত্রীর বড় ভাই মিজানুর রহমানের নামে এ জমি দখল দেখিয়ে নামজারির মাধ্যমে ব্যক্তিগত জমিতে রূপান্তর করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে নামজারি ও জমাভাগের মামলার (মামলা নং-৪১৭০/২০১০) মূল নথি গায়েব করা হয়েছে উল্লেখ করে দুদকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবরের দায়ের করা হাইকোর্টের রিট পিটিশনের (নং-১৪৬৮১/২০১৯) আদেশকে মিসগাইড করা হয়েছে। এ আদেশ যথাযথভাবে নিষ্পত্তি না করেই জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সরকারি কৌশলী মোহাম্মদ ইসহাকের সহায়তায় মিজানুর রহমানকে ২০২০ সালের ৯ জুলাই জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭ কোটি ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৪ অবৈধভাবে প্রদান করা হয়। এ টাকা থেকে ঘুষ/কমিশন বাবদ মেয়র মুজিবুর রহমানকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, মেয়রপুত্র হাসান মেহেদী রহমানকে ৩ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। অন্যদিকে একই প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জসিম উদ্দিন গং ক্ষতিপূরণ বাবদ ২ কোটি ২২ লাখ চার হাজার ১৮৭ টাকা পান। সেই টাকা থেকে কমিশন বাবদ এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কক্সবাজার শাখা হিসাবের মাধ্যমে নিয়েছেন মেয়র মুজিবুর রহমান। একই তারিখে এ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার একটি চেক স্ত্রীর ভাই মিজানুর রহমানকে দেন মেয়র।

    অনিয়ম-দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যাবহারে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা কক্সবাজারের মেয়র ও গুটিকয়েক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে দুদক অনুসন্ধান এবং মামলা দায়ের। এখনও সেসব রাগব-বোয়ালরা অধরা। দুদক বলছে, মাঝখানে করোনা মহামারির কারণে একটু স্থবির থাকলেও, সম্প্রতি আবারো কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে এই খাতের সন্দেহজনক ব্যক্তিদের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যাদের নামে মামলা করা হয়েছিল তাদের বেশিরভাগই উচ্চ আদলতের জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিশ্চিন্ত মনে। বারবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে আসলে দুদক কি চাচ্ছে সেই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে।




    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর