::: জেসমিন জুঁই :::
রাজধানী ঢাকার অনেক সুখ দুঃখের সাথী বঙ্গবাজার মার্কেট। একসময় মার্কেটটি মধ্যবিত্তের গ্রাহকের আস্থার ঠিকানা হিসেবে পরিচিতি পেলেও নব্বইয়ের দশকের পর সকল শ্রেণীর গ্রাহকের ভীড় দেখা যায় এই মার্কেটে। অনেকে এখানে বসে খুচরা ব্যবসার সাথে পাইকারি সরবরাহ করেন পণ্য। একারণে বঙ্গবাজার ছিল হাজারো ব্যবসায়ীর রুটি-রুজির ঠিকানা।
মঙ্গলবার আগুনে ভস্মীভূত হয় পুরো বঙ্গবাজার। সব হারিয়ে কাঁদছেন ব্যবসায়ীরা। তবে আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরে জনমনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কারা চালাতো বঙ্গবাজার?। কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল বিশাল এ মার্কেট। মালিকানা নিয়েও সাধারণ মানুষের মনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। কেউ বলেন বঙ্গবাজার মার্কেটের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আবার কেউ এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন । কেউ কেউ আবার বলে থাকেন দোকানদারদের সাব কবলায় কেনা এটি।
১৯৯০ সাল নাগাদ বঙ্গবাজার রূপান্তরিত হয় দেশের তৈরি পোশাক বিক্রির অন্যতম কেন্দ্রস্থলে। ২১,২৫০ বর্গফুট জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবাজার নিজের সঙ্গে জুড়ে নেয় পার্শ্ববর্তী আরো তিনটি মার্কেটকেও। তবে পুরোনো রেল স্টেশনকে ঘিরে বঙ্গবাজারের মতো হকারর্স মার্কেট এরও আগে দেখা যায়।
সমসাময়িকদের বর্ণনা মতে, গুলিস্তানের পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়িয়ায় রেলওয়ে স্টেশন ছিলো। ১৯৬৮ সালের ১ মে চালু হয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। যদিও কয়েক বছর পরই পুরনো রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ হয়ে যায়, তারপরও কিন্তু রমরমা অবস্থা জারি থাকে বঙ্গবাজারের। কেননা এটিই ছিল ওই এলাকার বেশকিছু ব্যস্ত সড়কের সংযোগস্থল।১৯৬৫ সালের দিকে এই স্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি বাজার। মূলত হকাররা মাথায় পণ্যের বোঝা চাপিয়ে রোজ এখানে আসতেন বিক্রি করতে। তারা বিক্রি করতেন বিভিন্ন মুখরোচক খাবার, পানীয়, শো-পিস এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি।
বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির পুরোনো কাগজপত্র অনুযায়ী , ১৯৭৫ সালের আগে এই মার্কেটের জায়গাটি ছিল মুলত রেলের মালিকানাধীন রেলওয়ে কলোনি। এখানে রেলের যন্ত্রপাতি রাখা হতো। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায়, ১৯৭৯ সালে রেলওয়ে জায়গাটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে।
১৯৭৫ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় টিনশেডগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটি মার্কেট বিল্ডিং গড়ে তোলার।কিন্তু সহসাই বাস্তবায়িত হয় না তাদের সেই প্রকল্প। কেননা বঙ্গবাজার যে জমির উপর গড়ে উঠেছিল, সেটির প্রকৃত মালিক ছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা রাজি হয়নি মালিকানার হাতবদল করতে।বরং রেলওয়ে বিভাগ বঙ্গবাজারের দোকান মালিকদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ফেলে যে দোকান মালিকরা ফি-বছর জমির অংশ ইজারা নেবে, এবং বৈধভাবে তাদের ব্যবসা চালাবে।
বছর খানেক সিটি করপোরেশন সেই জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছিলো। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে আশপাশের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা মার্কেটের জন্য জায়গাটি পেতে চেষ্টা চালান। সিটি করপোরেশনের কাছে লিখিত আবেদনও করেন তারা। মানবিক বিবেচনায় তৎকালীন মেয়র কর্নেল (অব.) আব্দুল মালেক ভ্রাম্যমাণ দোকান বসাতে অনুমতি দেন। পরে ব্যবসায়ীরা টিনশেডের কয়েকশ’ দোকান নির্মাণ করে ব্যবসা শুরু করেন। চারটি ইউনিটে ভাগ করে দোকান নির্মাণ করা হয়। তবে ১৯৯৫ সালে ভয়াবহ আগুনে ভস্মীভূত হয় পুরো বঙ্গবাজার মার্কেট।
বঙ্গবাজারের দোকান নিয়ে রাজনীতিও কম হয় নি৷ ১৯৯৫ সালে আগুন লাগানো হয় দোকানের দখল নিতে। তখন ব্যবসায়ীদের অনেকেই বঙ্গবাজার ছেড়ে ঢাকা ট্রেড সেন্টার ও সুন্দরবন মার্কেটে চলে যান। ১৯৯৬ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন নিজ উদ্যোগে তাদের ফিরিয়ে এনে বঙ্গবাজারে পুনর্বাসন করেন। ওই সময় জায়গাটি ভিটা অনুসারে ব্যবসায়ীদের কাছে নামমাত্র দামে বরাদ্দও দেন। প্রথমে জন প্রতি ২০ হাজার টাকা সালামি নিয়ে বঙ্গ কমপ্লেক্সে ২৯৬১ জনকে একটি করে দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময়ে দ্বিতীয় দফায় আবার ২৩৭০টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। তখন ১ লাখ টাকা করে সালামি নেয়া হয়। ২০১৪ সালে আবারো যাচাই-বাছাই করে ৫৯১ জনকে একটি করে দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। সিটি করপোরেশন বরাদ্দ দেয়া এসব দোকান থেকে প্রতি বছর সালামি তোলেন। স্কয়ার ফিট ১৭ টাকা হিসাবে। বছরের শুরুতেই এ টাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিটি দোকান প্রায় ১৫ থেকে ৭০ স্কয়ার ফিট পর্যন্ত। তবে পাশের এনেক্সকো টাওয়ারের জায়গার মালিক এখনো রেলওয়েই আছে। এমনটিই জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এভাবেই খুব সাদাসিধেভাবে গড়ে ওঠে বঙ্গবাজার, নিতান্তই একটি ‘হকার্স মার্কেট’ হিসেবে। তবে কেউই শুরুতর ধারণা করেন নি, এই বঙ্গবাজারই একসময় হয়ে উঠবে রাজধানীর সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র।
বঙ্গবাজার যখন ডিআইটির অধীনে, তখন কুমতলব আঁটতে থাকে হকাররা। জায়গাটিকে পাকাপাকিভাবে নিজেদের দখলে নিয়ে আসার লক্ষ্যে তারা অবৈধভাবে গড়ে তুলতে থাকে অস্থায়ী টিনশেড। ১৯৮৫ সালে বঙ্গবাজারের জায়গাটি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কাছে। এর বছর চারেক পর কর্পোরেশন সম্পন্ন করে তাদের পরিকল্পিত শপিং সেন্টারের নির্মাণকাজ।১৯৯০ সাল নাগাদ বঙ্গবাজার পুরোপুরি রূপান্তরিত হয় দেশের তৈরি পোশাক বিক্রির অন্যতম কেন্দ্রস্থলে। ২১,২৫০ বর্গফুট জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবাজার নিজের সঙ্গে জুড়ে নেয় পার্শ্ববর্তী আরো তিনটি মার্কেটকে। এখনো বঙ্গবাজারের রয়েছে মোট চারটি ইউনিট। বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স ছাড়াও এর অংশ হিসেবে রয়েছে গুলিস্তান, মহানগরি ও আদর্শ ইউনিট। সব মিলিয়ে দোকানের সংখ্যা প্রায় হাজার পাঁচেক।
১৯৯৫ সালে আগুন লাগার পর সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট এবং ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তর-দক্ষিণ মার্কেটটি খুব দ্রুত নির্মাণ করে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকানের মূল মালিকদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৪ সালে লটারির মাধ্যমে সেখানে তাদের দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীদের এই মার্কেটটিতেই দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। মার্কেটের মালিক সমিতি সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়ে টিনের দোকান তৈরি করে। সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি করে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে অনেক দোকানি অন্যের কাছ থেকে পজিশন কিনে একাধিক দোকানের মালিক হয়েছে।
বঙ্গবাজারে পাইকারি ও খুচরাভাবে শার্ট, প্যান্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, অন্তর্বাস, ফতুয়া, সোয়েটারের মতো তৈরি পোশাক তো বিক্রি হয়ই, সেইসঙ্গে আরো বিক্রি হয় সালোয়ার কামিজ, শাড়ি, জুতো।পুরোপুরি নতুন পোশাক যেমন থাকে, তেমনই সেকেন্ড হ্যান্ড কিংবা কারখানা থেকে বাতিল হওয়া অনেক পোশাকও এখানে পাওয়া যায় খুবই সস্তা দামে। তাই দেশি সাধারণ ক্রেতা ও বিক্রেতা থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল, ভুটান, ইরান এমনকি রাশিয়ার অনেক ব্যবসায়ীও এখানে থেকে পণ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
এইবাংলা/হিমেল