18 C
Dhaka
Sunday, February 16, 2025
More

    পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্ল্যাক রাইস, সফলতার হাতছানি

    আরও পড়ুন

    :::অপু ইব্রাহিম :::

    পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে  ক্যানসার প্রতিরোধী ব্ল্যাক রাইসসহ ঔষধি গুণসম্পন্ন চার জাতের ধানের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। নতুন ও আগাম জাতের এই ধানের ভালো ফলন হলে আগামীতে আরও বেশি পরিমাণ জমিতে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় চাষ করার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় চাষিরা। নতুন এই ধান চাষে সহযোগিতা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। কৃষি বিভাগ বলছে, ঔষধিগুণসম্পন্ন ব্ল্যাক রাইসের চাহিদা বাড়ছে। চাষিরা প্রতিকেজি ধান ৫০০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারবেন। আর এক বিঘা জমি থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার ধান পাওয়া সম্ভব।

    রোগবালাই কম ও উচ্চ ফলনশীল হলেও নিচু জামিতে কালো ধান চাষ করা সম্ভব। এমনকি কৃষক দাম ও ফলন দুটোই ভাল পাবার সম্ভাবনার কারণে এবছরে ব্ল্যাক রাইস ধানের বাম্পার ফলনের আশা দেখে যাচ্ছে  । সূত্র জানায়, অন্যধানের মতো এধানের লম্বা গাছ সবুজ হলেও ধানের শীষ ‘কালো’। গাছের ডগায় দুলছে কালো ধানের শীষ। কৃষকরা ব্ল্যাক রাইস দেখে মুগ্ধহন ও উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের মনে এখন নানা কৌতুহল।

    ব্লাক রাইস উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছেন লামার কৃষক জলিল।  তিনি জানান, ২৫ শতক জমিতে ভিয়েতনাম থেকে বীজ সংগ্রহ করে ব্ল্যাক রাইস চাষ করেছি। আগামীদিনে আরো ২বিঘা জমিতে এধান চাষ করবো। আমি সবসময় নতুন জাতের ফলন চাষ করি। এধান চাষে সার-কীটনাশক কম লাগে। ফলন অন্য ধানের চেয়ে ভাল। এমনকি আমার নিকট থেকে স্থানীয় কৃষকেরা ধান বীজ নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন

    জানা যায় , ব্লাক রাইস  সমতলের তুলনায় জুমের গুলো বেশি সুস্বাদু এবং জনপ্রিয়। একারণে ব্লাক রাইস বা বিন্নি চাল প্রধানত পাহাড়ীদের কাছে জনপ্রিয় হলেও সমতলের মানুষজন পিঠা ও অনান্য আনুষঙ্গিক উৎসবে ব্যবহার করে থাকেন। ঔষধিগুণসম্পন্ন ব্ল্যাক রাইসের উৎপাদন বাড়লে নতুন সম্ভাবনা যোগ হবে পার্বত্য অঞ্চলে।

    সরেজমিনে দেখা যায়, অন্যান্য ধানের মতোই এই ধানগাছ দেখতে সবুজ। তবে ধানগুলো কালো। প্রতিটি গাছের ডগায় ঝুলছে কালো ধানের শীষ। পার্বত্য অঞ্চলে বিন্নি চাল হিসেবেও পরিচিত এটি।

    কথা হয় কালো ধান চাষি মিয়ং চাকমার সঙ্গে। তিনি  বলেন, চীনের রাজা-বাদশাহদের সুস্বাস্থ্যের জন্য কালো ধান চাষ হতো। তবে এ ধান প্রজাদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। ঔষধি গুণাগুণের কারণে এই ধান চাষে ইচ্ছা জাগে তার। পরবর্তী সময়ে ইউটিউব দেখে এই ধানের চাষাবাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানেন। ২০০ গ্রাম ধানের বীজ সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে বাড়ির পাশে পাঁচ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন।

    পুষ্টিবিদদের মতে, অ্যান্থোসায়ানিন নামের একটি বিশেষ রাসায়নিক যৌগের কারণে এই ধানের চালের রং কালো হয়। আর অ্যান্থোসায়ানিন ক্যানসার ঠেকাতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। তাছাড়া বার্ধক্য, স্নাযুরোগ, ডায়াবেটিস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধেও অ্যান্থোসায়ানিনের জুড়ি মেলা ভার। এই চালে আয়রন ও ফাইবার বেশি, অথচ শর্করা কম। শর্করা কম মানে ডায়াবেটিস রোগীর আদর্শ পথ্য।

    জানা যায় ,  এ চালের গন্ধ গোবিন্দভোগের মতো। রপ্তানির চাহিদা বাড়ার কারণে ঝুম চাষিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এই ধানের চাষাবাদ। বীজ সংকটের কারণে বেশ কিছুদিন এ প্রজাতির ধান চাষে অনীহা তৈরি হয়েছিলো। তবে এখন ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম এই ব্লাক রাইসের প্রচলন ও ধাষে আগ্রহে বেড়েছে।

    এক সময় পার্বত্য  এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বিন্নি ধানের চাষ হতো তবে সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে আশির দশকে । সাম্প্রতিক সময়ে  তিন পার্বত্য জেলার কোথাও কোথাও চাষ হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও গত দুই বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে ব্লাক রাইসের চাষ হয়েছে  পার্বত্য অঞ্চলে।

    লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সানজিদা বিনতে সালাম বলেন, ‘  এখন লামা আলীকদম উপজেলায় এখনো এই ধান দেখা যায়। এ ধানের চাষ লাভজনক না হওয়ায় ধানটি হারিয়ে যেতে বসেছিল। এই ধানটি এখনি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অচিরে ধানটি আমরা হারিয়ে ফেলবো।’

    ধান গবেষণা ইনিস্টিউটের মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবির বলেন, ‘ রাঙামাটিতে জলেভাসা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। আমরা এ জমির কিছু অংশ কাজে লাগিয়ে উচ্চফলনশীল ধান চাষ করার জন্য কৃষকদের সম্পৃক্ত করছি। কেননা সরকারের ঘোষণা কোন পতিত জমি থাকবে না। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। পার্বত্য অঞ্চলে  ক্যানসার প্রতিরোধী ব্ল্যাক রাইসসহ ঔষধি গুণসম্পন্ন চার জাতের ধানের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এটি আশাব্যঞ্জক খবর। ‘

    রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ি,বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলা সহ এই অঞ্চলের আরেকটি পরিচিত চালের নাম বিন্নি চাল।এটি মূলত পাহাড়ের জুমে চাষ এবং সমতলের ধানীখেতে চাষ হয়ে থাকে, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলা সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনেক উপজেলায়, কক্সবাজার জেলার নানান জায়গায় সহ পাহাড়ে (জুম চাষ) চাষাবাদ হয়ে থাকে।

    এই চাল সমতলের তুলনায় জুমের গুলো বেশি সুস্বাদু এবং জনপ্রিয়। বিন্নি চাল প্রধানত পাহাড়ীদের কাছে জনপ্রিয় হলেও সমতলের মানুষজন পিঠা ও অনান্য আনুষঙ্গিক উৎসবে ব্যবহার করে থাকেন।

    ভালো মানের বিন্নি চালের জন্য রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি বাজার, বনরুপা বাজার, কলেজগেট বাজার ঘুরে দেখা যায়, এই চালের প্রধান বিক্রেতা পাহাড়ী নারীরা, তাদের কাছে প্রধানত তিন রকমের বিন্নি চাল পাওয়া যায় যা সাদা,কালো, এবং লাল বিন্নি চাল ।

    তাছাড়া তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় কালো বিন্নি চাল অন্য চালের তুলনায় বেশি চলে, এছাড়াও লাল সাদা মিশ্র বিন্নি চাল পাওয়া যায়।চালের মান অনুসারে দাম হয়ে থাকে। তবে খুচরাভাবে কেনা বিন্নি চাল সমতল বাজারের তুলনায় পাহাড়ি বাজারে কম দামে পাওয়া যায় । তবে বিদেশে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় থাকার কারণে ব্লাক রাইস উৎপাদনে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে কৃষকরা।

    স্থানীয়রা জানান, বিন্নি চালের ভাত মূলত অন্য চালের তুলনায় আঠালো এবং সুস্বাদু যার কারণে অনেক ভিন্ন হয় সাধারণ ভাতের তুলনায়। এছাড়াও বিন্নি চালের আতিক্কা পিঠা এই অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়, কলা পাতা দিয়ে মুড়িয়ে এই পিঠা বানানো হয় বিভিন্ন উৎসবে। এই চালের ভাত দুধ ও মধু মিশিয়ে খাওয়ার মধ্য আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়।

    জানতে চাইলে বান্দারবানের লামার বাসিন্দা ব্যবসায়ী  মনতোষ তংচোঙ্গা বলেন, এই চাল দিয়ে এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মধুভাত তৈরী করা হতো। এখনও হচ্ছে।  যা সব বয়সী সকলের কাছে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এছাড়াও পাহাড়ী অঞ্চলে বাঁশের চোঙার ভেতর নারিকেল কুচি দিয়ে রান্না করা ‘বিন্নি ভাত’ অনেক জনপ্রিয় যা পাহাড়ী রেস্টুরেন্টে খোঁজ নিলেই পাওয়া যাবে।

    বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৭০ শতাংশ ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং দেশের গ্রামীণ শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ এ কাজে নিয়োজিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  ধান চাষে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের গবেষণা ও উদ্ভাবন বাড়ানো,  ভালো কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করা,  দেশের ফসল-পরবর্তী ক্ষমতা এবং ব্লাক রাইসের মতো ব্র্যান্ডের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে রপ্তানি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

    এইবাংলা/হিমেল

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর