::: নাদিরা শিমু :::
মেঘনা নদী বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী এবং পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম।সার কারখানার ক্ষতিকর বর্জ্য মেঘনার পানিকে দুষিত করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠা কারখানার কারণে মেঘনার পানি দূষণমুক্ত রাখতে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নে দুই বছর আগে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) ও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) মধ্যে একটি চুক্তি সই করা হয়েছিলো।
সাম্প্রতিক সময়ে ধরে মেঘনা নদীর পানি বিবর্ণ হয়ে গেছর। পানি দূষণের ফলে ছোট প্রজাতির মাছ মারা যাচ্ছে। ক্ষতির প্রভাব পড়েছে মতলবের জীববৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদেও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেঘনা নদীর মতলব উত্তর অংশে থাকা মাছ এবং মাছের পোনা মরে যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। পচা মাছের দুর্গন্ধে মেঘনা নদীর আশপাশে ঘেঁষা দুরূহ হয়ে পড়েছে। যে কারণে নদী তীরবর্তীরা দৈনন্দিন কাজও ব্যবহার করতে পারছে না নদীর পানি। গত এক সপ্তাহে প্রায় কয়েক টন দেশি চেউয়া মাছ ও বিভিন্ন জাতের পোনা মাছসহ ছোট বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে গেছে।
মেঘনার পানি দূষণের ফলে বাবু বাজার, ইস্পাহানির চর, গজারিয়া, ষাটনল, সটাকি, মহনপুর, এখলাসপুরসহ প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠেছে তীরে। জাটকা, পোয়া, বেলে, চেউয়া, চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নদীতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনাসহ বেঁচে নেই কোনো জলজ প্রাণী। নদীর তীরে পড়ে থাকা এসম মাছ পচে, গলে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছে। ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে নদীর পানি।
স্থানীয় মৎস্য বিভাগের দাবি, আশপাশের শিল্পকারখানাগুলো নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলছে। স্থানীয় লোকজন হাটবাজার ও বাসাবাড়ির আবর্জনাও নদীতে ফেলছেন। ফলে পানি দূষিত হয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
নদীর তীরে বড় ধরনের দখলবাজিতে লিপ্ত মেঘনা গ্রুপ। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গিয়ে মেঘনা গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠান প্রবাহমান মেঘনা নদীর ২৪১ দশমিক ২৭ একর জমি অবৈধ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৭৭ একর নদীর জমিতে মূল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আবার ৫ দশমিক ৫ একর জমিতে নির্মাণ করেছে নিজস্ব রাস্তা।
মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর পাশের ষাটনল ইউনিয়নের জেলেপাড়া, বাবু বাজার, সটাকী, বাহাদুরপুর এলাকায় পানি দুর্গন্ধযুক্ত । এখানে পানি নষ্ট হয়ে কালো রং ধারণ করেছে এবং চোখে পড়ছর ফেনাযুক্ত পানি। পানিতে মরা মাছ ভাসতে দেখা যাচ্ছর।
জেলেদের প্রতিনিধি ফুলচান বর্মন জানান, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের কারখানার পরিত্যক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। বর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ‘
স্থানীয়রা জানায়, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কলকারখানার দূষিত কেমিক্যালযুক্ত পানি মেঘনা নদীর তলদেশ দিয়ে আসায় ছোট-বড় মাছ মরে ভেসে উঠছে। পচা মাছের দুর্গন্ধে নদী পাড়ের মানুষের জীবনমান দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
মতলব উত্তর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার নদীর পানি এখানে প্রবেশ করেছে। এক সপ্তাহ ধরে নদীর পানির রং বদলে যাচ্ছে। শহরের বিভিন্ন কারখানার দূষিত বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে পানি দূষিত হয়ে রং পরিবর্তন করেছে। দূষিত পানির কারণে পানির পিএইচ ও অ্যামোনিয়া মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রায় শূন্য হয়ে যাওয়ায় নদীতে থাকা বিভিন্ন জাতের বড় মাছ, মাছের পোনা ও জলজ প্রাণী মরে যাচ্ছে।
গত এক সপ্তাহে নদীর ষাটনল এলাকায় কয়েক টন মাছ মরে গেছে। মাছগুলো মরে ভেসে গেছে এবং নদীর পাড়ে জমাট হয়ে পচে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম বলেন , মাছ মারা যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা হবে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, বর্জ্যের কারণে নদীর পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় মাছ মরে ভেসে উঠছে। ‘
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘খবর পাওয়ার পর পরই সহকারী মৎস্য কর্মকর্তাকে নদীর অবস্থা দেখতে পাঠানো হয়েছে। পানিতে মিশে থাকা দূষিত পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই পানি বুধবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।’
চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি জানিয়েছেন। আগামী রবিবার সরেজমিন পরিদর্শন করে পানির নমুনা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রমাগত দুষণ আর দখলের কারণে ইলিশের বৃহত্তম বিচরণ ক্ষেত্র ও অভয়াশ্রম (ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার) নষ্টসহ জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘনা নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রধান প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ সম্প্রতি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।’
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে শত শত ড্রেজারের আঘাতে, নির্গত পোড়া মবিল ও তেলের কারণে মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য নদীর প্লাংটন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে নদীর পানি দূষণ সম্পর্কে মৎস্য বিজ্ঞানীরাও প্রাথমিক পর্যায়ে সত্যতা পেয়েছেন। তারা বলছেন, নদী দূষণ বন্ধ করা না গেলে আগামীতে মেঘনায় ইলিশসহ সব মাছের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, দুগন্ধের পাশাপাশি কালচে বর্ণ ধারণ করে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে মেঘনা নদীর পানি। মেঘনা নদীর দূষণ থামাতে নেয়া দুই বছর আগে নেয়া সেই মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছিল ১১ কোটি চার লাখ টাকা। কিন্তু কোন কিছুই অস্তিত্ব সংকটে পড়া ‘মেঘনা’ নদীকে বাঁচাতে পারেনি।
এইবাংলা /হিমেল