::: রাহাত আহমেদ :::
সারাদেশে মেডিকেলে পড়াশোনা করা ছাড়াই চিকিৎসা দিচ্ছেন অসংখ্য প্রতারক। সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় সাধারণ রোগীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এসব ‘ভুয়া চিকিৎসক’। এছাড়া ‘এমবিবিএস’ পাস করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবেই রোগী দেখছেন এমন চিকিৎসকের সংখ্যাও কম নয়। সুত্রমতে, সারাদেশে চিকিৎসকদের সংগঠনই পৃষ্ঠপোষকতা করছে এসব চিকিৎসকদের। একারণে উচ্চতর ডিগ্রি না থাকলেও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। প্রশাসনের অভিযানের চোখও এসব কথিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপরে নেই৷
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনায় কোন ধরনের ডিগ্রি ছাড়াই রোগী দেখছেন জোহরা আক্তার। তার জাতীয় পরিচয় পত্রে নামের আগে যুক্ত করা হয়েছে ‘ডাক্তার’ টাইটেল। ফলে রোগীদের এই ভুয়া ডাক্তারের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। অন্তত দুই যুগ ধরে গাইনি চিকিৎসকের ভুমিকায় আছেন তিনি। কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা থেকে তার চেম্বারে রোগী সংগ্রহ করে আনার নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছেন তিনি৷ গড়ে তুলেছেন মা- মনি মেডিকেল সেন্টার।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা-বাগুর বাস স্টেশন এলাকায় গড়ে ‘মা-মনি মেডিকেল সেন্টারে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রোগীদের জটলা। কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবীদ্বার এলাকার খ্যাতিমান এই চিকিৎসকের এমবিবিএস ডিগ্রি নেই সেটি শুনে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অনেকেই চোখ কপালে তুলছেন।
ডাক্তার জোহরা আক্তারের বেশ খ্যাতি যশ আছে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাতের কাজে । সন্তান প্রসব করাতে গ্রামেগঞ্জে প্যাকেজে মেডিকেল টিম নিয়ে যান। সুত্রমতে, অনাকাঙ্খিত ভ্রুণ গর্ভপাত করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে এরইমধ্যে কোটিপতি বনেছেন সনদহীন এই চিকিৎসক।
শুধু অনাকাঙ্খিত ভ্রুণ গর্ভপাত নয় গর্ভবতী মা’দের নিয়মিত চেকআপ, পরীক্ষা নিরীক্ষা, ডেলিভারি, সিজার করিয়ে এতটাই পরিচিতি অর্জন করেছেন ; কেউ ভুলেও তার শিক্ষাগত ‘সনদ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন নি কখনো।
সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা-বাগুর বাস স্টেশন সংলগ্ন ‘মা-মনি মেডিকেল সেন্টারে’ গিয়ে দেখা মেলে জোহরা আক্তারের । জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, প্রসূতি মায়ের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তিনি। তবে ‘এমবিবিএস ‘ ডিগ্রিধারী নন তিনি। বিএমডিসির সনদও নেই তার। ‘
তাহলে জাতীয় পরিচয় পত্র অনুযায়ী তার নামের আগে কেন ডাক্তার লেখা আছে? সাইনবোর্ড বা প্রেসক্রিপশন প্যাডে নামের আগে ‘ ডাঃ ‘ পদবী কিভাবে আসলো -এমন প্রশ্নের উত্তরে জোহরার সাবলীল জবাব ‘ ওটা নামের অংশ ‘।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জোহরা জাতীয় পরিচয় পত্রে তার নামের আগে ডাঃ যুক্ত করেছেন টাকা খরচ করেই। সুত্রমতে, জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরি জন্য তিনি জাল এমবিবিএস সনদ ব্যবহার করেছিলেন। জমা দিয়েছেন ভূয়া ‘বিএমডিসি’ সনদও৷ এনআইডি সার্ভার অনুযায়ী জোহরা আক্তারের জন্মসাল ১৯৭৯। পিতার নাম ‘হাজী মোঃ আবদুল হামিদ মজুমদার ‘। মায়ের নাম রাব্নু বেগম। জোহরা আক্তারের নামের ভিন্ন এক এমবিবিএস ডিগ্রিধারীর সনদ ব্যবহার করে দীর্ঘদিন দুই যুগ ধরে রোগী দেখছেন ‘জোহরা’। তবে তিনি সেই জাল সনদের বিষয়টি সামনে না এনে অকপটে বললেন ‘ডাঃ’ তার নামেরই অংশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার বাসিন্দা জোহরা আক্তার। ১৯৯৯ সালে প্রাইভেট ক্লিনিকে সেবিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিন বছর কাজ শিখে ২০০২ সাল থেকে বনে যান এমবিবিএস (গাইনি) চিকিৎসক। এরপর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি জোহরার৷ কোন ডিগ্রি ছাড়া নিজে নিজেই বনে গেছে গাইনি চিকিৎসক। কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। নিজের মেডিকেল সেন্টারে প্রশিক্ষিত নার্সও রেখেছেন।
শুধু কুমিল্লা নয় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় এমন ভুয়া ডাক্তারের খোঁজ মিলেছে অনুসন্ধানে। গেল বছরের জানুয়ারীতে সাত ভুয়া চিকিৎসককে আটকের সুত্র ধরে চীন থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি ( জালিয়াতি) শেষ করে রাজধানী চিকিৎসা দিচ্ছেন এমন ১৪ জন ভুয়া ডাক্তার শনাক্ত করে দুদক। তারা বিএমডিসির বৈধ সনদও তৈরি করেছিলো। দুদকের সুত্র জানায়, ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে দুদক সাতজনকে আটক করে। চীনে পর্যটক ভিসায় ভ্রমনে গিয়ে দেশে ফিরে ডাক্তার বনে যাওয়া মোট ১৩ জনকে শনাক্ত করে সংস্থাটি। স্কুল অফ ইন্টারন্যালশান এডুকেশন তাইশান মেডিক্যাল ইউনির্ভাসিটিতে এমবিবিএস পাস করার সনদ দেখিয়ে বিএমডিসির সনদ সংগ্রহ করেছিলেন তারা। সম্প্রতি আটক হওয়া সেই তেরজনসহ মোট ১৬ জন প্রতারকের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
দুদকের নথি অনুযায়ী, স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন তাইশান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সার্টিফিকেট জাল হিসেবে শনাক্ত করেছেন। দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয় এই ১৩ জন ব্যক্তির কেউ কেউ পর্যটক ভিসায় চীনে যান। এমবিবিএস ডিগ্রিধারী হিসেবে এমবিবিএস সনদ দেখিয়ে বিএমডিসির সনদও নিয়েছিলেন । সনদগুলোর স্বাক্ষরের সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য হস্তলেখা বিশারদের মতামত গ্রহণ করা হয়, তাতেও দেখা যায় যে বিএমডিসির সনদ ঠিক থাকলেও এমবিবিএস সনদের স্বাক্ষরগুলোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এক বছর অনুসন্ধান শেষ সংস্থাটির তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে বলেন, ওই ১৩ জন ভুয়া এমবিবিএস সনদধারী কখনো চীনের তাইশান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি। কেউ কেউ কেবলমাত্র ট্যুরিস্ট ভিসায় চীনে গিয়েছিলেন, বাকিদের চীনে বসবাসের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণও নেই।
চট্টগ্রামের হালিশহরের জে ব্লকে মনিরুল ইসলাম নামের এমনই এক দন্ত্য চিকিৎসকের খোঁজ পাওয়া গেছে। তার প্রেসক্রিপশন প্যাড, সাইনবোর্ড সবখানেই নিজের নামের আগে ‘ ডাঃ ‘ লিখে রেখেছেন। ডেন্টাল সার্জন হিসেবেই রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। শনিবার ভ্রাম্যমাণ আদালত হাজির হবার পর তিনি শিকার করলেন পেট চালাতে তিনি ডাক্তার লিখেছেন। তবে তিনি দাঁতের চিকিৎসা বুঝেন, জানেন। দাঁতের রুট ক্যানেল, স্কালিং, পিলিংয়ের কাজ শেখা আছে। নিজের অপরাধ শিকার করে নেবার পর তাকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত। সাথে এক লক্ষ টাকা আর্থিক জরিমানাও করা হয়।
এইবাংলা/তুহিন