::: নিজস্ব প্রতিবেদক :::
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং একজন আলোকচিত্রী সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। বলা হচ্ছে এই মামলা করা হয়েছে বাংলাদেশে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সৃষ্ট সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দুতাবাসও শনিবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাংবাদিক নিপীড়ন নিয়ে নেতিবাচক বিবৃতি দিয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার ঘটনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করছে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। একইসঙ্গে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা অবিলম্বে তুলে নেওয়া, প্রথম আলোর প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসের মুক্তি ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা সব ধরনের মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গেলো বৃহস্পতিবার নোয়াব সভাপতি একে আজাদের দেওয়া বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রথম আলো তাদের শত্রু এমন বক্তব্য দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর প্রথম আরোর পক্ষ থেকে নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ বলেছেন, প্রথম আলো সরকারের শুত্রু নয়, কারন প্রথম আলো সাংবাদিকতার বাইরে কিছু করে না।
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর তীব্র সমালোচনা করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শনিবার আওয়ামী লীগের এক সভায় মি. কাদের তার বক্তব্যে বলেন, প্রথম আলো সরকার এবং আওয়ামী লীগকে শত্রু ভাবে।বিএনপিকে আমরা ভাবি প্রতিপক্ষ, বিএনপি আমাদের ভাবে শত্রু। প্রথম আলো আমাদের শত্রু ভাবে। তাদের প্রত্যেকটা সম্পাদকীয় পলিসি আওয়ামী লীগের সাথে শত্রুতা, যেটা বিএনপি রাজনীতি একই রাজনীতিকে তারা সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে আজকের বাস্তবতা- বলেন ওবায়দুল কাদের। তাঁর এই বক্তব্য দেশের বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে প্রচার করা হয়।
সরকারকে হেয় করতে প্রথম আলো ও বিএনপি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে- বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, ‘প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম আলো আর বিএনপি একজন আরেকজনের পরিপূরক।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, এভাবে তারা আজকে বাংলাদেশে একটা জনপ্রিয় সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, বিশ্ব সমাজের কাছে খাটো করার জন্য, এই সরকারকে জন-বিচ্ছিন্ন করার জন্য …. হেন কোন তৎপরতা নেই যা বিএনপি নামক দল এবং প্রথম আলো নামক পত্রিকাটি না করছে।”
পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারের সাথে প্রথম আলোর কোনো বৈরিতা নেই এবং প্রথম আলো সাংবাদিকতার বাইরে আর কিছুই করে না।
“প্রথম আলো বের করার সময়ই আমরা বলেছিলাম যে আমরা দল নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করবো। এখনো বলি আমরা কোনো দলের সঙ্গে নেই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আছি । দল নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ব্রত নিয়ে প্রথম আলো যাত্রা শুরু করেছিলো। পাশাপাশি বলেছিলাম আমাদের সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কারণ এর মধ্যেই গণতন্ত্র, সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবাধিকার অন্তর্নিহিত আছে।”
স্বাধীনতা দিবসের একটি প্রতিবেদন প্রকাশকে ঘিরে প্রথম আলো ও সরকর এক প্রকার মুখোমুখি অবস্থানে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে শামসুজ্জামান শামস নামের প্রথম আলোর এক সংবাদকর্মীকে। এরপর গতকাল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ স্থগিত করার আহ্বান জানান জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন।
ফলকার টুর্ক বলেছেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি পুনরায় কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিলম্বে এর প্রয়োগ স্থগিত এবং এই আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর ধারাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’
তাঁর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এই আইনে দুই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। সর্বশেষ ২৯ মার্চ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সংবাদপত্র প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান এর শিকার হয়েছেন। বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাঁকে আটক করা হয়েছে। সঙ্গে তাঁর ল্যাপটপ, ফোন ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করে নেওয়া হয়েছে। তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে।
এদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিত করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। আইনটি যুগোপযোগীভাবে সংশোধনের দাবিও জানায় সংগঠনটি।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আজ শনিবার ঐক্য পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিতের দাবি জানানো হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংবাদিকদের জন্য খড়গ হয়ে এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বিশেষ করে আঞ্চলিক সাংবাদিকেরা বেশি ঝুঁকিতে। ২০২০ সালে এই আইনের অধীন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের লোকজন গড়ে চারটি করে মামলা করেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এই আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা বেশি হয়েছে। ২৫ ও ৩১ ধারা দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আদালতও প্রশ্ন তুলেছিলেন।
গ্লোবাল টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘ পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যায়, গত চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগ হয়েছে বেশি। জামিন-অযোগ্য ধারার নিবর্তনমূলক ব্যবহার বেশি হয়েছে। প্রগতিশীল গোষ্ঠী এই আইনে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। ‘
তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০১৮ সালে ৩৪টি, ২০১৯ সালে ৬৩টি, ২০২০ সালে ১৯৭টি, ২০২১ সালে ২৩৮টি মামলা হয়। ধারাবাহিকভাবে টানা চার বছর মামলার সংখ্যা বাড়ার পরের বছরে তা কমে আসে। ২০২২ সালে এ আইনে মামলা হয় ১২২টি।
এইবাংলা /হিমেল