28 C
Dhaka
Monday, April 28, 2025
More

    দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টে কি ভুল ছিলো

    আরও পড়ুন

    :::ওয়াহিদ জামান :::

    ছবি ছাড়াও সংবাদের কাটামো হয়। দৈনিক পত্রিকায় ছবি ছাড়া সংবাদও করা হয়। সাংবাদিকতায় ছবির বহুমাত্রিক ব্যবহার সাংবাদিকতার আধুনিক সংস্করণ। দৈনিক প্রথম আলোর যে রিপোর্ট নিয়ে এতো লঙ্কাকান্ড হচ্ছে সেই প্রতিবেদনে  ভুলটা আসলে কোথায় সেই বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ জরুরি। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবার পর নানাজন নানা কথা বলছেন। সমালোচকদের সবারই মূল কথা হলো ‘সবুজ’ এই কথা বলেননি। ছবিটির সাথে প্রতিবেদনের মুল  বক্তব্যের সামঞ্জস্য নেই ; এটাই মুলকথা।

    কিন্তু জাকির নামের অন্যএক দিনমজুর একই গল্পে উপস্থিত ছিলেন। তার বক্তব্যকে লিড করে, অন্য ছবি ব্যবহার করা হলে – সেটি সাংবাদিকতার নীতি লঙ্ঘন করে না কোনভাবেই। ট্যাগলাইনসহ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিরে আসা বা ভাইরাল হবার মাঝেই এই প্রতিবেদনের স্বার্থকতা। কারণ এমন একটি বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে যেটি সাধারণ মানুষের মনের ভাবনাকে প্রকাশ করেছে।

    কোন একটি সংবাদে ছবি ও ইনফো ট্যাগ ব্যবহার করা হয় প্রতিবেদনকে আকর্ষণীয় করার জন্য। ফিচার ইমেজ হিসেবে অনলাইনে একই সাথে  একটার বেশি ছবি ব্যবহার করা হয় না। প্রতিবেদনের ভেতরের একের অধিক ছবি সংযুক্ত করা যাবে, ফিচার ইমেজে নয়।  কিন্ত একটি টেলিভিশন একই বিষয়ে অনুসন্ধানী  প্রতিবেদন প্রকাশ করে এর মাধ্যমে প্রতিবেদনটির তথ্যগত ভুল প্রমাণ করার চাইতে,  বিভ্রান্তি তৈরি করে দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বক্তব্য দেবার জন্য সবুজকে দশ টাকা দেওয়ার অভিযোগও তোলা হয়েছে।

    ছবিটিও সেই প্রতিবেদনের অংশ ছিলো,কিন্তু  কোনভাবেই ছবিটি অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ ফুল বিক্রেতা হিসেবে সেই ছোট্ট শিশুর বক্তব্য নেয়া হয়েছে। একই সাথে দিন মজুর জাকিরের বক্তব্যকে লিড করা সাংবাদিকতা মৌলিক কাটামোকে লঙ্ঘন করে না। কেউ কেউ  বাজারে গিয়ে ঘাম ঝরা বা ভাতের স্বাধীনতার কথাটাকে ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা প্রচারের অভিযোগ তুলেছেন। স্বাধীনতাকে ভাতের স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনাকে ধৃষ্ঠতা মনে হতে পারে ; তবে প্রতিবেদন কখনোই রাস্ট্রের প্রতি ধৃষ্টতার উদ্দেশ্য তৈরি করা হয় না।

    কিন্তু বাস্তবতা দেখানোর জন্য কোন ছবিকে ব্যবহার করে যেই ম্যানিপুলেশন করা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ছবিটি তেমন  সমস্যা তৈরি করার কথা ছিলো না। যদিও সংবাদ মাধ্যমের জন্য ক্রপিং বা আলোর সামঞ্জস্যের মতো ছোটখাটো পরিবর্তন করা সাধারণ। সাংবাদিকদের জন্য এমনভাবে একটি ফটো সম্পাদনা করা অনৈতিক যা এর অর্থ পরিবর্তন করে বা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। কিন্তু এমন অভ্যাস পেশাদার সংবাদ মাধ্যমে  ঘটে না। প্রথম আলোর সেই প্রতিবেদনেও ঘটেনি। কারণ দেশের নাগরিকদের বড় একটি অংশই মনে করেন ভাতের স্বাধীনতা যদি না থাকে, কেউ যদি দুই বেলা ভাত খেতে না পারে,  তাহলে  এই স্বাধীনতা দিয়ে কি হবে ! প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধই হয়েছিল জনগণের  ভাত ও অর্থনৈতিক  বৈষম্যে বিপরীতে  স্বাধীন জীবনাচরনের জন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণেই  মুক্তিপাগল বাঙালি  স্বাধীনতা চেয়েছিলো।  স্বাধীনতা মানে দুই বেলা পেটপুরে যেন খেতে পারা।  নিজেদের খাবারটা যেন কেউ হরণ করে নিয়ে যেতে না পারে সেই অধিকার সুরক্ষিত থাকা।বর্তমানে ঠিক তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রের দোষ নেই, স্বাধীনতার দোষ নেই। তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের দোষ থাকতে পারে। নানা কারণে বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। বয়লার মুরগির দাম কমানোর সফলতা বৈশ্বিক মন্দার কারনে দামবৃদ্ধির একমাত্র কারণকে ম্লান করে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেঁচে থাকার কস্ট হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে। দ্রব্য মুল্যের ধারাবাহিক উর্ধ্বগতি শুধুই কি বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি?

    নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামবৃদ্ধি যতটা না ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, তার চেয়ে বেশি আমলা-ব্যবসায়ী-রাজনীতিকদের দুর্নীতি, লোভ, বা অনৈতিক-অবৈধভাবে অধিক অর্থ আয়ের লালসা। সাধারন মানুষের এমন ধারনা অমূলক নয়।

    প্রকৃত চিত্রই হচ্ছে এক শ্রেনীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে সাধারণ মানুষ চরমভকবে শোষিত। জনগণকে  জিম্মি করে অবৈধভাবে উপার্জিত  অর্থ বিদেশে পাচার করছে একই শ্রেণী । তারা বিদেশে  গাড়ি-বাড়ি করছে। আর দেশের মানুষের ভাত কাপড়ের স্বাধীনতা নেই। বিদেশে পাচার হওয়া  অর্থের পরিমান হাজার হাজার কোটি টাকা।।স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে একই ধরনের শোষনের চিত্রই বিদ্যমান ছিলো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সেই গোলামী ও শোষনের জিঞ্জির ভাঙতে চেয়েছিলেন বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো।

    পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেভাবে শোষন করেছিলো বাংলাদেশকে,  অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল। সেই একই কাজ তো করছে দেশের লুটেরামহল। তাদেরকেই দেশদ্রোহী বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে  আইনের আওতায় আনার কথা রাষ্ট্রের। অথচ ঘটছে  উল্টো, সুশাসন বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

    স্বাধীনতা দিবসে একজন দিন মজুর ভাতের স্বাধীনতা চেয়েছেন, তাতে চটে গেছেন মাননীয় সরকার তথা ক্ষমতার তোষামোদকারী মহল। একটি পত্রিকা সেটি শিরোনাম করেছে বলে তা অন্যায় হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

    প্রথম আলো একজন দিন মজুরের বক্তব্যের সাথে একটা শিশুর কার্ড বানিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তখন প্রশ্ন উঠেছে এই ভাতের স্বাধীনতার কথাটি এই শিশু বলতে পারে? বক্তব্য ও ছবির সঙ্গে মিল না থাকায় তা সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের হুজুগে বাঙালী তা নিয়েই শুরু করেছে তোলপাড়।অথচ আরো বড় ভুল তো করেছে সেই বেসরকারি টেলিভিশন। যেখানে সবুজ নামে সেই শিশুকে এই ভাতের স্বাধীনতার বক্তব্যদাতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বক্তব্য তো দিনমজুর জাকিরের।এটাই তো মিথ্যা প্রচারণা, প্রোপাগান্ডা। মিথ্যা বা প্রোপাগান্ডা প্রচারের জন্য তাদেরকেই বরং প্রেস কাউন্সিলের মুখোমুখি করা উচিত।এদিকে এই যে সামান্য একটা বিষয়, তা নিয়ে হঠাৎ সরকার এতো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে কেন?

    আমার বিশ্লেষণ হলো- ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা গণমাধ্যমের কোনও তালিকা যদি করি, তবে তার প্রথম সিরিয়ালে থাকবে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার। তারাও যে সবকিছু বা সকল সত্য প্রকাশ করতে পারে তা নয়। তবে তারা অন্যদের থেকে এগিয়ে। এক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছলতা বা অন্যান্য অনেক কারণও রয়েছে। তো সরকার চাইতেছে এই দুই পত্রিকাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এজন্য মূলত মামলাগুলো হয়েছে। শামসকে ধরা হয়েছে। মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার পর আর এসব কিছু থাকবে না।

    বিগত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলার নাই। আগামী নির্বাচনও একইভাবে হবে। এজন্য আগে থেকেই একটা ভয়ের সংস্কৃতি জারি রাখাটাই মূলত মূখ্য বিষয়। এতে আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রভাবের পাত্তা সরকার দিতে চায় না। নির্বাচন পার হলে সবাইকে ম্যানেজ করা যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে  এই দেশে সু-সাংবাদিকতার চেয়ে তেলবাজি বেশি হয়। একটা শ্রেণী সত্য খবর প্রকাশের চেয়ে ধান্দায় মনোযোগী থাকে বেশি।

    অনেক সিনিয়র সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের সেই প্রতিবেদনকে রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সাংবাদিকতাকে বেড়ি পরাতে চেয়েছেন। একটি প্রতিবেদনে চারজনের বক্তব্য থাকলে তার মধ্য একটিকেই ফিচার ইমেজে ব্যবহার করা হয়। যারা অনলাইনের এই ফরম্যাট বুঝেন তাদের কাছে বিষয়টি পরিস্কার। এখন কেউ যদি চায় তার প্রতিবেদনে জাকির ছবি ফিচারিং করবে তাহলে শিশুটির ছবির বদলে সেটি ব্যবহার করতে পারেন। একজন শিশুর কাছে স্বাধীনতার কথা জিজ্ঞেস করতে কোন সাংবাদিকের যাবার কথা নয়। তার কাছে ফুল বিক্রিই মুখ্য। দশ টাকা দিয়ে প্রতিবেদক তার কাছ থেকে একটা ফুলও কিনতে পারেন। দোষের কিছু নেই। কারণে শিশুটি বক্তব্য তার বয়স ও বুদ্ধিমত্তার পরিমন্ডল অনুযায়ী বিবেচনায় আসবে।

    এমন বিতর্কে জড়িয়ে একটি শিশুকে নিপীড়ন করা হয়েছে এমন যুক্তি  উপস্থাপন করেছেন কেউ কেউ। কারণ বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ১৪ (১) ধারায় সংবাদমাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে৷ এখানে তো শিশুটি নির্যাতন বা নিপীড়নের শিকার হন নি।

    আইনে বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনে অপরাধের শিকার হয়েছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদপত্রে বা অন্য কোন সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়৷ (২) উপ-ধারা (১) এর বিধান লংঘন করা হইলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ি ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন৷’’

    একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন , ম্যাগাজিনের ফিচার স্টোরী, সংবাদ বিভাগ বা অনলাইন নিবন্ধে ছবি ছাড়া পুরো বিষয়টি  খাপছাড়া দেখায়। ছবি শুধুমাত্র একটি গল্প উন্নত করতে সাহায্য করে না, ছবি এটির নিজস্ব গল্পও বলে। যখন প্রতিবেদক চিন্তাভাবনা করে সংবাদে কোন ছবি অন্তর্ভুক্ত করেন, সেটি  প্রসঙ্গ এবং বোধগম্যতা যোগ করে। তার মানে এই নয় যে ‘ছবিই পুরো সংবাদকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। প্রথম আলোর সেই প্রতিবেদনেও ছবিটি স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতি সৌধে  একটি শিশুর (ফুল বিক্রেতা) উদযাপনকে উপস্থাপন করেছে। তবে সাংবাদিকতার জগতে, ভালো ছবি একটি গল্প তৈরি বা ভাঙতে পারে। প্রতিবেদক বহুমাত্রিক  ফটোসাংবাদিকতাকে নিজের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈপুণ্য হিসাবে দেখাতে ছবিটি দিয়েছেন – এভাবে ভাবলেই প্রতিবেদনটি নিয়ে এতো প্রশ্ন তৈরি হতো না।

    ওবায়দুল কাদেরসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা প্রথম আলোর সেই সাংবাদিক গ্রেফতারের বিষয়ের সাথে প্রতিবেদনে  শিশুকে ব্যবহারের মতো অপরাধের  তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।

    সাংবাদিকতার ইতিহাসে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ছবি তোলা হচ্ছে  এবং আগের মতো ভুল তথ্য ছড়ানোর সুযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের  সক্ষমতার জন্য কমেছে। মুল প্রতিবেদনের তথ্য অনুধাবন না করে বিজ্ঞাপন ফটোগ্রাফির ছবি সংবাদের মুল বিষয় হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।

    তবে সাংবাদিকের ফটো ম্যানিপুলেশনের কৌশল সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন,  একটি ফটোগ্রাফ প্রতিবেদনের সাথে প্রাসঙ্গিক  হয়েছে কিনা সেটি  চিহ্নিত করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, ইমেজ ফিচারিং এর  জ্ঞান প্রতিটি সাংবাদিকের দক্ষতার অংশ হওয়া উচিত যাতে তারা স্বাধীনভাবে এবং বাস্তবসম্মতভাবে সংবাদ তৈরিতে সক্ষম হয়।

    এইবাংলা/সিপি

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর