:::ওয়াহিদ জামান :::
‘প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি’ শ্লোগানের আলোয় নতুন করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে চায় যে দল ; তাদের শাসনামলে একজন সাংবাদিককে ভোররাতে বাড়ি থেকে তুলে নেয়া বিদীর্ণবসনা গণতন্ত্রের সর্বশেষ নজীর স্থাপন বলা চলে। রাষ্ট্রের কোন সাধারণ মানুষকে কারণ দেখানো ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে তুলে এনে ; পরে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেয়া, সেই ঘোষণাকে বৈধতা দিয়ে মামলা সৃস্টি- এমন নজির কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নেই। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ সেই রাষ্ট্রকে স্বাধীন হিসেবে হয়তো বলা যায় ; কিন্তু গণতান্ত্রিক বলা উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকদের যতোটা সুরক্ষা দেয়া হয়েছে, তারচেয়ে বেশি মুক্ত গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল সরকার সমালোচনায় ভীত হয়ে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করেছে। বলাই বাহুল্য স্বাধীন বাংলাদেশে এখন সেই ভীতিকর পরিবেশই তৈরি হয়েছে।
বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে অন্তত মামলা দিয়ে চালান দেয়া হয়েছে, ‘গুম ‘ এর তালিকায় তার স্থান হয় নি এমন মহানুভবতার জন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। তবে, রাজনীতি সচেতন কোন মানুষই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করে গণমাধ্যমের উপর এমন নির্লজ্জ আক্রমণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সবশেষ বসনটি খুলে নেবার মতো এই লোক হাসানো ঘটনাকে সাধুবাদ জানাবে না। বলা হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি- এ চার মূলভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মতো ভোররাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তুলে নেয়াই যদি হয় ‘স্মার্ট গভর্নমেন্ট’ এর নমুনা ; তাহলে সামনে আরও অনেক খারাপ নজীর স্থাপিত হবে ধরেই নিতে হচ্ছে।
বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে আবার ডিজিটাল আইনেই হাতকড়া পড়িয়ে চলেছেন। অথচ এই আইনের অন্তত চারটি ধারার (২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারা) সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে । আইনের এই ধারাগুলো রাষ্ট্রের সংবিধানের ৩১ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্বাধীনতার মাসে কতটি মামলা দায়ের করা হয়েছে সেই পরিসংখ্যান হাতের কাছে নেই। তবে একদিনেই (২৯ শে মার্চ) চারটি মামলা হয়েছে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকির কারণ হবে না – আওয়ামী লীগের নেতা, শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী – আমলাদের এমন বচনে আর আস্থা নেই সাংবাদিকদের। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ গণমাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশে আইনের হাতকড়া পড়িয়েছেন। আইনটির ২৫ ধারার (১) উপধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে “যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে,-(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণু করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।”
এ ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৩ (তিন) বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।”
অথচ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। গত সাড়ে চার বছরে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে দেশে। একারণে রাষ্ট্রের স্বার্থে সাংবাদিকতার স্বাধীন ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্রুত সংশোধন অত্যন্ত জরুরি।
একটি মুক্ত গণমাধ্যম একটি গণতান্ত্রিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমরা যখন ভোটের মাধ্যমে আমাদের পছন্দের জনপ্রতিনিধি বাছাই করি বা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে ভোট দিই তখন আমাদের সচেতন পছন্দ করার জন্য, আসলে কী ঘটছে তা আমাদের জানতে হবে। মুক্ত সংবাদ জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, রাষ্ট্রের নীতি এবং ঘটনা সম্পর্কে আমাদের সরাসরি খবর দিতে পারে যদি এটি সরকার বা প্রতাপশালীদের প্রভাবমুক্ত থাকে ।
আমাদের মতো দূর্নীতিগ্রস্থ দেশে গণমাধ্যম ‘ ওয়াচডগ’ হিসেবে কাজ করে । মুক্ত গণমাধ্যম ক্ষমতাসীন সরকার বা অন্যান্য সত্তার দৃষ্টিভঙ্গি বা তাদের ভয়ে কাজ করে না বলেই সাংবাদিকরা রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রের সুবিধাভোগীদের সম্পর্কে অবাঞ্চিত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে। দুর্নীতি,দূর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ- এমন সব অপকর্মের বিষয়ে জনগণের জানার অধিকার না থাকলে সেই রাষ্ট্রকে স্বাধীন বলা সমীচীন হবে না। বলতে গেলে মুক্ত সংবাদ গণতন্ত্রের স্তরের সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িত, গণতন্ত্রের সূচককে নির্বিশেষে স্পষ্ট করে ‘ মুক্ত গণমাধ্যম ‘।
অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা, “সঠিক” লাইনে আঙ্গুল না তোলা, সাংবাদিকদের নিয়ে কুটকৌশল করা – নতুন কিছু নয়। ইতিহাস জুড়ে এটি সারা বিশ্বের শাসকদের দ্বারা গৃহীত হয়েছে – শুধুমাত্র একনায়কদের দ্বারা নয়। এপর্যন্ত ৪৫ টি আন্তর্জাতিক সংস্থা, সংগঠন একই সুরে বলেছে বাংলাদেশ কেবল একটি কথিত গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালোআইন সাংবাদিকতাকে অপরাধ প্রমাণিত করতে বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে আসছে।
যুক্তরাজ্যের মতো উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন নজির স্থাপিত হয় গেল বছরের নভেম্বরের শেষ দিকে। দেশটির ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা মহাসড়কে (M25) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবাদ কভার করার সময় চার সাংবাদিকের সম্ভাব্য বেআইনি গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের অপরাধ জাস্ট স্টপ অয়েলের সমর্থকরা ব্যস্ত মহাসড়কে (এম ২৫) গ্যান্ট্রিতে উঠে প্রতিবাদ জানাচ্ছে ; আর সেটি সাংবাদিকরা কাভার করেছেন।
এলবিসি রিপোর্টার শার্লট লিঞ্চ, প্রেস ফটোগ্রাফার টম বোলস, চলচ্চিত্র নির্মাতা রিচ ফেলগেট এবং নাম প্রকাশ করা হয়নি এমন একজনকে গ্রেপ্তার করার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সব দল অনুধাবন করতে বাধ্য হন এমন ন্যাক্কারজনক গ্রেপ্তার অতিউৎসাহী পুলিশ অফিসারদের দ্বারা অতিরঞ্জিত ভুল ছিল। পাশাপাশি গ্রেপ্তারের পরিবর্তে হার্টফোর্ডশায়ার কনস্ট্যাবুলারির আরও সিনিয়র অফিসারদের দ্বারা পুলিশিং পরিকল্পনা পরিচালিত হয়েছিল, যা সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে থাকতে পারে ; এমন সম্ভাবনা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। মুহূর্তেই পর্যালোচনা আর সমালোচনার ঝড় বৃটিশ পার্লামেন্টে পৌঁছে৷ সংসদে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পরে একটি পর্যালোচনায় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র প্রতিবাদস্থলে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারে তার অস্বস্তি প্রকাশ করতে বাধ্য হন।
হার্টফোর্ডশায়ার পুলিশের নেতৃত্ব দেন এমন বৃটিশ প্রধান কনস্টেবল চার্লি হল ‘জাস্ট স্টপ অয়েল ‘ বিক্ষোভ কভার করার সময় ভুলভাবে গ্রেপ্তার হওয়া সেসব সাংবাদিককে বলেছেন তিনি তার অফিসারদের কাজের জন্য “সত্যিই দুঃখিত”। চার্লি হল এলবিসি রিপোর্টার শার্লট লিঞ্চকে লিখেছিলেন “এই গ্রেপ্তারে আমরা স্পষ্টতই কিছু ভুল পেয়েছি”।
লেখক ::: সংবাদকর্মী