::: ওয়াহিদ জামান :::
দ্রব্য মুল্যের উর্ধগতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও থামেনি পুরান ঢাকার ইফতারি বিলাস। মুঘল আমলে রান্নায় দেওয়া হতো সুগন্ধি মশলা, বাদাম, শুষ্ক ফল, জাফরান, গোলাপ জল, সেই ধারার প্রচলন আছে এখনো। মুঘল এসব রান্নায় উজবেকিস্থান, পারস্য, আফগানিস্তানের নানা দ্রব্যের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। পুরান ঢাকার বাবুর্চিরা এখনো দূর্লভ এসব মসলা নিজেদের সংগ্রহে রেখেছেন। প্রথম রমজানে পুরান ঢাকার তৈরি দামি এসব ইফতারির ডালা দেখে কেউই বলবে না, মানুষের হাতে টাকা নেই। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ইফতার সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে দামী ইফতারি বিক্রি গতবছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
ঢাকায় ইফতারের সবচেয়ে বড় বাজার বসে পুরান ঢাকার চকবাজারে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি ইফতারির দোকান। দুপুরের পর থেকে বাড়তে থাকে ভিড়। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে মানুষজন আসেন ইফতার কিনতে। প্রথম রমজানে সেই ভীড় ঠেকেছে অসহনীয়।
চকবাজারে যেসব ইফতারের আয়োজন করা হয় সেগুলো মোঘল আমলে রাজা-বাদশারা খেতেন এমন কথার প্রচলন ঢাকার ঘরে ঘরে। তাই উচ্চ বিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ম মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের কেউই রাজা বাদশার ইফতারিতে ভাঙতে চান রোজা। পুরান ঢাকার বিভিন্ন দোকানে মোঘল শাহী ইফতারি নানা নামে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মোগল ইফতারি সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ঘ্রাণ। ঘ্রাণে বিমোহিত ক্রেতারা দামের চিন্তা বাদ দিয়ে ঘরে নিয়ে ফিরেছেন পছন্দের ইফতার সামগ্রী। সুতি কাবাব, শাহী পরটা, সিঙ্গারা, শাহী হালিমসহ মশলাদার খাবারের সুগন্ধ পুরো এলাকাকে সুঘ্রাণের রাজ্যে পরিণত করেছে। সেই সুঘ্রাণে বিমোহিত ক্রেতারা তাই পকেটের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তোয়াক্কা করার কথা যেন ভাবছেনই না।
কুণ্ডলিকা’ এবং ‘জালাভলিকা’ নাম দেয়া হয়েছে দেশের বহুল পরিচিত জিলাপির। একই জিলাপির বাহারি নাম ‘জালাবিয়া’ ‘জিলিপি’, ‘জিলিবিয়া’ ‘জেলি’।
কথা হলো রশিদ বাবুর্চির সাথে। জানালেন কাচ্চি, হায়দ্রাবাদি, লক্ষ্ণৌই বিরিয়ানির পাশাপাশি তিনি সাদা পোলাও, কিমা পোলাও, মটর পোলাও, মোরগ পোলাও তৈরিতে পটু। মুরগির বাড়তি দামে ক্রেতাদের আগ্রহে ভাটা পড়েনি জানালেন তিনি।
রহিম বাবুর্চি তার রান্না করা মাংসে ব্যবহার করেন মৌরি ও হিং। জানালেন তার হাতের সুস্বাদু ‘ রোগান জোশ’ এর রহস্য। পেঁয়াজ, রসুন আর কাস্মীরী মোরোগচূড়া গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল ব্যবহার করে এই খাবারকে তিনি বানিয়েছেন ভোজনরসিক জিহবার জন্য লোভনীয়।
রান্নার ঝোলকে সুস্বাদু ও ঘন করার জন্য তাতে দুধ, দুধের সর, দই মেশানো হয়। রান্নার পর সাজানোর জন্য ফুলের পাপড়ি ছড়ানো হয়েছে। আর টাটকা রাখার জন্য সোনার এবং রূপার তবকে মোড়ানো হয়েছে ইফতারের নানা খাবার।
বাবুর্চিরা বলছেন ইফতারের নানা পদের রান্নার পূর্ণ মাত্রায় যাতে খাদ্যগুণ বজায় থাকে সেজন্য বিরিয়ানির চালের প্রতিটি দানা রূপক ফলক নিঃসৃত তেল মাখানো হচ্ছে ; সেটি হজম ও কামনা উদ্দীপনার জন্য উপকারী বলছেন তারা।
ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ আছে উত্তর ভারতীয়রা নিরামিষভোজী হওয়ায় কারণে মাংসে প্রস্তুত মজাদার খাবার সেখানে পাওয়া যেতো না। সেকারণেই সম্রাট বাবর সেসময়কার ভারতীয় খাবার পছন্দ করতেন না। সম্রাট বাবরের শাসনামলে ইরান পারস্যের শাহ থেকে উপহারপ্রাপ্ত বাবুর্চিদের নিয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। যারা পারসিক রন্ধনশৈলীতে খাবার প্রস্তুত করতো। পরবর্তীতে সম্রাট বাবর তাঁর অধীনে কর্মরত স্থানীয় বাবুর্চিদের পারসিক ও স্থানীয় রন্ধনশৈলীর সমন্বয়ে এক নতুন পদ্ধতিতে রান্না করার উপদেশ দেন। এভাবেই হিন্দুস্তানি রন্ধনশৈলী তথা মুঘলাই খাবারের সূচনা ঘটে ; প্রচলন আছে আজও।
এখানকার বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার নিহারী। সেই নিহারীর প্রচলন রয়েছে দেশের সব জেলায়। নিহার কথাটির অর্থ হল সকাল। যেহেতু এই খাবারটি সকালের প্রাতঃরাশে খাওয়া হতো সেকারনে এর নামও নিহারী। মোঘল সাম্রাজ্যে এই খাদ্যের প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় ভোরবেলা নামাজ পড়ার পর এমন সুস্বাদু খাদ্য খাওয়ার রেওয়াজ ছিলো, সেই থেকে এই খাদ্যের নাম নিহারী।
পুরান ঢাকায় রমজানে মিলছে ঢাকাই, লাখনৌয়ি, সিন্ধী, হায়দারাবাদী, বোম্বাই, কলকাতাই, মালাবারী, থালেশ্বরী ও দিল্লী’র বিরিয়ানি ও হালিম। অনেকের কাছে এসব কাবার “অত্যন্ত তৈলাক্ত এবং বিস্বাদ” ; ক্রেতাদের সেই সংখ্যাটা নগন্য।
মুরগিকে লোহার শিকে ঝলসানো হচ্ছে কয়লার আগুনে, যতক্ষন না তা বাদামী রঙ ধারণ করে। ভালোমতন ভাজা হয়ে গেলে পরে তার উপর লবণ, জিরা দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।
পুরান ঢাকায় ফলের দোকান দু-একটি থাকলেও সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে মাংস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রকমের খাবারের দোকান। রমজানে পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমতকে ছাপিয়ে মুরগির রোষ্ট, সুতি কাবাব, খাশির রেজালা, কোয়েল পাখির রোষ্ট, ফুচকা, দই বড়া, হালিম, মাঠা, পরোটা, শাহী জিলাপি আরও নানা পদের ইফতারী জানান দিচ্ছে সময়টা ‘ মাহে রমজান’।
এইবাংলা/হিমেল