::: আফরিন আফসার :::
খুলনার শহর থেকে উনিশ কিলোমিটার গেলে ফুলতলা উপজেলা। ফুলতলা উপজেলার তিন কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে দক্ষিণডিহি গ্রাম অবস্থিত। এই গ্রামেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি, একই গ্রামেই তার মামা বাড়িও। জায়গাটি দেশের ভ্রমন পিয়াসি মানুষের কাছে ততটা পরিচিতি পায় নি। খুলনা যশোহর পাকা সড়কের বেজের ডাংগা বাসস্টপের এক মাইল পূর্বে অবস্থিত এই বাড়িটি বিশ্ব কবি রবি ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি, বর্তমানে পরিচিত রবীন্দ্র কমপ্লেক্স হিসেবে।
রবিঠাকুরের সাহচর্যে এসেছিলেন যেসব মানুষ, তাঁদের মধ্যে এমন ক্ষুদ্র মনের আর কেউ তো নেই। রবি ঠাকুরের লেখায় দৈনন্দিন সংসারের ছোটখাটো ঘটনা, তিরস্কার, তাঁর অসহিষ্ণুতা যতটট সুচারুভাবে ফুটে উঠেছে —ততটাই অব্যক্ত এই দক্ষিণদিহির কথা। ফুল, ফল আর বিচিত্র গাছ গাছালিতে ঠাসা সৌম্য-শান্তগ্রাম দক্ষিণডিহি গ্রামের ঠিক মধ্য খানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিধন্য একটি দোতলা ভবন। এটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি। এখান থেকেই কলকাতাতে পাড়ি জমান দক্ষিণডিহির ঠাকুর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য।যৌবনে বিশ্বকবি কয়েকবার মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামাবাড়িতে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
এখানে এলেই নয়ন জুড়াবে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ ভাস্কর্য, কবিপত্নীর আবক্ষ ভাষ্কর্য, শ্বশুর বাড়ির দ্বিতল ভবন দেখে। এছাড়া রয়েছে সবুজ-শ্যামল ঘন বাগান, পান-বরজ ও নার্সারি। জানা যায়, বিয়ের আগে, অর্থাৎ ১৮৮৩ সালের আগে বেনীমাধব রায় চৌধুরীর যে বাড়িটি এখানে ছিল সেটি ছিল টিনের তৈরি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ে ভবতারিনী দেবী ওরফে ফেলীর বিয়ের পর নাকি বর্তমানে দৃশ্যমান দোতলা বাড়িটি তৈরি করা হয়।বিয়ের আগে ছিলেন ভবতারিণী। কেউ বলেন প্রাক্তন বান্ধবীর নামের আদলে পরে তাঁর নাম বদলে দেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। প্রয়াণদিনের ঠিক এক মাস আগে কবিপত্নীর সংক্ষিপ্ত জীবনের মায়াতুর কাহিনি গাঁথছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধুদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। তেমনই একদিন খেতে আসতে বলেছেন বিলেতে একই শিক্ষকের কাছে পড়া প্রিয়বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে। তারপর ভুলেও গিয়েছেন বেমালুম। স্ত্রীকে বন্ধুর কথা বলা তো দূরের কথা, নিজে খেয়েও নিয়েছেন দুপুরের খাবার। বিশ্রাম নিচ্ছেন। এমন সময় হাজির প্রিয়নাথ সেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন কী ভুলটাই না হয়েছে !
রবীন্দ্র কমপ্লেক্সে শতবর্ষী এই দ্বিতল ভবনের উপর একটি চিলেকোঠা কবিগুরু রবীন রয়ে নাথ ঠাকুরের স্মৃতি বহন করছে। মূল ভবনের নীচ তলায় ৪টি এবং দ্বিতলে ২টি কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণ দিকে আছে একটি বারান্দা। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এই ভবনটি বাহ্যিক পরিমাপ ১৫.৫৫মিটার (দৈর্ঘ্য) ও ৭.৮৮ মিটার (প্রস্থ)। বারান্দার পরিমাপ ৮.১২ মিটার (দৈর্ঘ্য) ও ৩.৪২মিটার (প্রস্থ)। ভবনের দেয়ালের পুরুত্ব ০.৬০মিটার। ভবনের নীচতলার উচ্চতা ৪.০১মিটার। উপর তলার উচ্চাতা ৪.২১ মিটার। ভবনটির দেয়ালের গাথুনীতে ব্যবহৃত ইটের পরিমাপ ২৫সেমি, ১২সেমি ও ৭সেমি। ভবনের স্থাপত্য ও গঠন কাঠামোতে বৃটিশ যুগের স্থাপত্য রীতিনীতির প্রভাব সুস্পষ্ট।
সম্ভবত উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই ভবন নির্মিত হয়েছিল। দক্ষিণ দিকে ৫ টি ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ির সাহায্যে ৩টি অর্ধবৃত্তাকার খিলানপথের মধ্যে দিয়া বারান্দায় প্রবেশের পথ রয়েছে। খিলান তিনটি দুটি গোলাকার স্তম্ভের উপর স্থাপিত। পূর্ব-পশ্চিম দিকেও বারান্দায় দুটি অর্ধ বৃত্তাকার খিলান আছে। ভবনটির ছাদ লোহার কাড়িকাঠ ও বর্গার সমন্বয়ে নির্মিত।
ভবনের ছাদের তলদেশ লোহা ও কাঠের বর্গার উপর স্থাপিত। একতল ও দ্বিতলা ছাদ বরাবর সমান্তরাল কার্ণিস আছে। ছাদের উপরে দক্ষিণ দিকে একটি প্যারাপেট আছে। প্যারাপেটের মধ্যে চুন বালির কাজ করা নকশা রয়েছে। নীচ তলায় ৮টি দরজা ও ২১টি জানালা আছে। ভবনের দরজা জানালায় কাঠের খড়খড়ি রয়েছে। জানালা ও দরজায় পিতলের কব্জা আছে। নীচতলার বারান্দায় প্রবেশের পর মূল ভবনে প্রবেশের জন্য ১টি দরজা ও ২ পার্শ্বে ২টি জানালা আছে। জানালায় মোটা লোহার গরাদ আছে। ভিতরে ও বাহিরে ২টি করিয়া প্রতি জানালায় কাঠের মোট ৪টি পাল্লা আছে। কোন কোন জানালায় কাঠের খড়খড়ি দেখা যায়। নীচ তলায় একটি কক্ষে কাঠের পাল্লা যুক্ত দেয়াল আলমিরা আছে।
দ্বিতলে মোট ৭টি দরজা এবং ৬ট জানালা আছে। দোতলায় নীচ তলার অনুরুপ কাঠের পাল্লাযুক্ত তিনটি দেয়াল আলমিরা আছে। দ্বিতলের বারান্দার সম্মুখ ভাগে ৬টি গোলাকার স্তম্ভ ক্যাপিটালসহ দৃশ্যমান। বারান্দার পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে লোহার রেলিং রয়েছে। দ্বিতলের বারান্দার উভয় পার্শ্বে লোহার রেলিং এবং উপরে ড্রপওয়াল হিসাবে ব্যবহৃত কাঠের খড়খড়ি আছে। সিঁড়ির সাহায্যে দোতলায় ও তিনতলার চিলিকোঠায় ওঠার ব্যবস্থা আছে।
লোহার কারুকার্য খোচিত নকশার উপরে কাঠের নির্মিত সিড়ির রেলিং রহিয়াছে। মূল ভবনের পূর্বদিকে চারটি অর্ধবৃত্তকার প্রবেশপথসহ একটি কক্ষ আছে। উত্তর দিকের দেওয়ালের বাহিরের দিকে নীচতলার ছাদ বরাবর অনেকগুলি লোহার কড়া সমান্তরাল ভাবে লাগানো আছে। সম্ভব একটি চালা সংযুক্ত ছিল এটি । এই দিকের দোতালার জানালাগুলির বাহিরের দিক কাঠের সানশেড দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। এতে বৃষ্টির পানি ঘরে প্রবেশ করতে পারতো না।
বাড়ির প্রবেশমুখে ও ভেতরে রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবীর বাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য আছে তার কোথাও রবীন্দ্রনাথ এ বাড়িতে এসেছিলেন কিনা সেটি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। আর বাড়ির বিষয়ে বললে এখানে লাল ইটের বাড়িটির উপর বাহ্যিক কাঠামো ঠিক রেখে প্লাস্টার করে নতুন রুপ দেয়া হয়েছে।
চার শতক জায়গার ওপর যে ভবনটি এখন দৃশ্যমান সেটি কবে কে নির্মাণ করেন তার সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। বাড়িটি কে তৈরি করেছিলেন তা স্পষ্ট করে কোথাও লেখা নেই। কেউ বলেন, বিয়ের পর নাকি রবীন্দ্রনাথ নিজেই এটি বানিয়ে দেন। তবে এর কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই।
বাংলা সাহিত্যের এই নক্ষত্রের আদিপুরুষ ও তার স্বজনরা ছড়িয়ে আছে খুলনা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। রবি ঠাকুরের পূর্বপুরুষের আদি নিবাসও খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ নামক গ্রামে। যদিও একথা ১৯৫২ সালের আগে কারও জানা ছিল না। এই পিঠাভোগ নামক গ্রামটি ঘাটভোগ ইউনিয়নভূক্ত।