::: রাহাত আহমেদ, হিমেল গোস্বামী :::
দিন গড়ালেই পবিত্র রমজান মাস শুরু। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য প্রতি বছর রমজানের আমেজ ভিন্ন ধরনের হলেও, এবার রহমতের রমজানকে ‘পুলসিরাত’ হিসেবে দেখছেন দেশের অধিকাংশ মানুষ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্যের আকাশ ছোঁয়া দাম। গ্যাস, বিদ্যুৎ থেকে কাঁচামরিচের ঝাল- সবখানেই চোখ কপালে তোলা দামের মিটার। একারণে নিম্মবৃত্ত মানুষ সেহরির ছাড়াই রোজা রাখার জন্য মনস্থির করেছেন, রোজা রাখার জন্য মধ্যবিত্তের সম্বল ‘পাতলা খিচুড়ি ‘। রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন জেলা শহরের বেশকিছু মানুষের সাথে কথা বলে এমন আভাস মিলেছে।
জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর পর বয়লার মুরগী, চাল, ডাল, মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ডিমসহ দূরের পথে পরিবহন করতে হয় এরকম সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে অন্তত ত্রিশ শতাংশ। মাসের খরচে বেড়েছে চাকরিজীবীদের যাতায়াত ভাড়াও। গ্যাস বিদ্যুৎ এর দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণে যখন দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে সাধারণ মানুষের, তখনই এলো রমজান । সব মিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস সাথে সাথে রমজানের দামের ‘ পুলসিরাত ‘ যোগ হয়েছে।
চাল, চিনি, ছোলা থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম ও তরিতরকারি, আদা, রসুন, পিঁয়াজ- কোনো কিছুর দামই কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগন্জের সংশ্লিষ্টরা। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি করে থাকেন এই ধরনের তিনজন আমদানিকারকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের কেউই এক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষার পরও এলসির ড্রাফট করতে পারেন নি। হিমায়িত মাছের পাশাপাশি রমজান উপলক্ষে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও ছোলা আমদানির চেষ্টা চলছে। কিন্তু সোনালী ব্যাংক এবং বেসরকারি এবি ব্যাংক- দুটি প্রতিষ্ঠানই আমদানিকারকদের ড্রাফট দিতে পারছেন না।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ডলার সংকটে আমদানি কমে যাবার কারণে ব্যস্ততা কম। এছাড়া সিএন্ডএফ এসোশিয়েশন কর্মবিরতি পালন করছে। ‘
এবার রমজান মাসে পণ্যের দাম নাগালের বাইরে যাবে না বলে জানাচ্ছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছেন, ‘ দেশে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই। আসন্ন রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।’
কিন্তু তার বক্তব্যের সাথে বাজারের চালচিত্রের আকাশ পাতাল ফারাক। রমজান মাসে বাজারে তেল, ছোলা, খেজুর, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। ভোক্তা অধিদফতর ৩০ শতাংশ দাম বাড়ার কথা জানিয়েছে।
কাস্টমসের সূত্র মতে , ২০২০-২১ অর্থবছরে ছোলা আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৫ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৮ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছোলা আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৩৬৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুধু গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এক লাখ ৩০ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন ছোলা এসেছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসেছে আরও ২৮ হাজার মেট্রিক টন ছোলা। ‘
কিন্তু ছোলার আমদানি বাড়ার পরও চাহিদা থাকায় কেজিতে দামের মিটারে যোগ হয়েছে ১০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে ছোলার কেজি ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। মানভেদে সেই ছোলা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। গতবছর ভারত, বার্মা, ভুটানসহ তেরটি দেশ থেকে আমদানি করা ছোলা খুচরা বাজারে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছিলো। ২২ – ২৫ শতাংশ বেড়েছে ছোলা দাম। গেল পাঁচজনের পরিবারের জন্য পুরো মাসের ছোলা কিনতে নয়শ টাকা ব্যয় করেছেন কর কর্মকর্তা শিবলী আহমেদ। এবার একই ধরনের ছোলা পরিমানে কম কিনেও ব্যয় হয়েছে ১৩৩০ টাকা।
এছাড়া, অ্যাংকর ডাল কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে বিক্রি সব বাজারে হচ্ছে ৭০ টাকা। রমজানের পণ্য বলে পরিচিত বেসনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। খেসারির ডাল ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন খোলা তেল কেজি প্রতি ১৯০ টাকা, পাম ওয়েল ১৫০ টাকা এবং চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি দরে।
এ যেন দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। সাধারণত রমজানের আগের ২/৩ দিন বাজারে সারেন দেশের অধিকাংশ পরিবার। গতকালের বাজারের চিত্রে আগের দিন মঙ্গলবারের চেয়ে খারাপ।
এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তাদের উদ্দেশে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি উপদেশ, ‘তাড়াহুড়ো করে একবারে অনেক বেশি পণ্য কিনলে বাজারের সরবরাহ শৃঙ্খলায় চাপ সৃষ্টি হয়। ভোক্তাদের উচিত যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই পণ্য কেনা। বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দেবে না, ভোক্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
আতন্ক যেন কিছুতেই ছাড়ছে না সাধারণ মানুষের। বেশ কিছুদিন থেকে মাসের খরচে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে, তার উপর রমজানে দ্রব্যমুল্যের এমন হাল। মধ্যবিত্তের মুখ ফ্যাকাসে করে দেয়া ‘রমজান’ নিয়ে অধিকাংশ পরিবারে দুশ্চিন্তা ভর করেছে। ইফতার ও সেহরীর মেন্যু কাটছাট করে কোনভাবে মাস কাটাতে চান কাঁঠালবাগানের শিউলী আকতার।
বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত শিউলি বলেন ‘ গতবছর রমজানের এক সপ্তাহের বাজার করেছিলাম সাতাশ শ টাকায়। এবার পাঁচহাজার টাকায়ও বাজার শেষ করতে পারলাম না। ‘
কারওয়ান বাজার থেকে পুরো মাসের বাজার করেছেন ব্যাংক কর্মকর্তা মুক্তার হোসেন। তিনিও জানালেন, ‘ বাজারে দামের মিটার কতোটা চড়া। ১/২ দিনের ব্যবধানে দাম আরও বেড়েছে। ‘
শুধু দরিদ্র মানুষ নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও নানারকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। বস্তুত কিছু অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অথচ পবিত্র রমজান মাসেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। রমজানকে সামনে রেখে এই মূল্যবৃদ্ধি সেসব সীমিত আয়ের মানুষের ওপর নতুন করে আঘাত হেনেছে , যাঁরা ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতিতে নাকাল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এরআগে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছিল, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমার প্রভাব কি পড়েছে?
চট্টগ্রাম শহরে স্বামী, শ্বশুর -শাশুড়ী, নিজের সন্তানসহ আট সদস্যের পরিবার চলে স্কুল শিক্ষিকা তাসলিমা বেগমের টাকায়। কারণ গার্মেন্টস বন্ধ হবার কারণে স্বামী ইকবাল চাকরি হারিয়ে বেকার।
তাসলিমা জানান, পরিবারের খাবার খরচ, বড় তিন সন্তানের স্কুলের খরচ সবকিছুর পর মাস শেষ হবার আগেই পকেট ফাঁকা। পাড়ার দোকানে বাকিতে চলে মাসের শেষ সপ্তাহ। মাসের বেশির ভাগ দিনই আমরা ভাত, ডাল, আলু ভর্তা খেয়ে পার করছি। রমজানেও একইভাবে যাবে।
এইবাংলা/হিমেল