::: ওয়াহিদ জামান :::
‘ ট্রমা কাভারেজ ‘ সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যেটি উত্তর আধুনিক যুগে সামাজিক নর্মস এবং ভ্যালুর সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ‘ সংবাদ’ হিসেবে সেসব বিষয় বা বিষয়বস্তুর বিবরণ তুলে আনা হয়, যা সাধারন মানুষের কৌতুহল মেটাতে সক্ষম। ভিন্নভাবে বললে সব শ্রেণীর দর্শক বা পাঠক সেসব তথ্য পেতে চায় ; সেসব ঘটনা বা তথ্যই আসলে সংবাদের অনুষঙ্গ।
এখন পাঠক আগ্রহ বা কৌতুহল থাকা শর্তেও কিছু ঘটনার বা দূর্ঘটনার বিশদ বিবরণ গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে দেখানো বা লেখা উচিত নয়। যেমন ‘ধর্ষণ ‘ – ধর্ষণ বিবরণ বা বিশদভাবে বর্ণনা পাঠক বা দর্শকের কাছে কৌতুহলের জন্ম দিতেই পারে ; কিন্তু এক্ষেত্রে সাংবাদিকতার ব্যাপকতা বা গভীরতার চেয়ে যতিই প্রাসঙ্গিক। এখন ধর্ষণের মতো ট্রমাটিক ঘটনার শিকার ভুক্তভোগীর কাছে ধর্ষণের বর্ণনা শুনতে চাওয়া বা মৃত্যুর মুখোমুখি আহত ব্যক্তির কাছে অনুভূতি জানতে চাওয়া স্পষ্ট অপ-সাংবাদিকতা। একজন পেশাদার সংবাদকর্মীকে ভুক্তভোগী বা ভুক্তভোগীদের মানসিক যন্ত্রণা প্রশমনের ( mitigate) প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।
TRAUMATIC ইস্যু হলো এমন ঘটনা বা দূর্ঘটনা যা ভুক্তভোগী বা প্রত্যক্ষদর্শিদের উপর মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। যেটি তাকে বা তাদেরকে গুরুতর মানসিক এবং মানসিক সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে। সেকারণে ট্রমাট্রিক ঘটনা বা দূর্ঘটনা কাভারেজ করার জন্য Post-traumatic stress disorder কে সতর্কতার সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। ট্রমা পরবর্তী মানসিক জটিলতা ‘Post-traumatic stress disorder’ (PTSD) হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের এমন অবস্থা যা ভয়ংকর কোন দূর্ঘটনা বা দূর্ঘটনার আকষ্মিকতায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটায় , ঘটনার স্মৃতিচারণের কারণে ভুক্তভোগীর মধ্যে হতাশা, বিক্ষুব্ধ মনোভাব ইত্যাদি তৈরি করতে পারে।
বিষয়টি পুরোপুরি সাংবাদিকতা, মনো-চিকিৎসা নয়। ঘটনা বা দূর্ঘটনার সাথে পথ চলার কারণে গণমাধ্যম কর্মীদের এই বিষয়ে পূর্ব প্রস্তুতি রাখার জন্য ট্রমাটিক কাভারেজের ক্ষেত্রে কিছু নর্মস তৈরি করা হয়েছে মাত্র।এখন টিভি সাংবাদিকদের ভাইরাল হবার একটা মনোভাব দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় করোনাকালে আইটিপিসিআর ল্যাব পরিদর্শন, অগ্নিকান্ড বা বিস্ফোরণ কাভারেজে নিরাপদ দুরত্ব বজার না রাখা, ঘুর্ণিঝড় কাভারেজে সমুদ্রের টেউয়ের খুব কাছাকাছি গিয়ে বিপদের পাশঘেঁষা এবং লাইভে সংযুক্ত হওয়া, যথাযথ নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া বোম ডিসপোজাল ইউনিটের কাছাকাছি থেকে কাভারেজ দেয়া – এমন অনেক ঘটনা বা দূর্ঘটনাকে দৃশ্যমান করতে গিয়ে ট্রমাটিক দূর্ঘটনার জন্ম দিয়েছে অনেক সংবাদকর্মী। একারণে ট্রমাটিক ঘটনা, ট্রমার শিকার ব্যক্তি বা বিষয়বস্তুর বিষয়ে সতর্ক থেকে নির্দিষ্ট গন্ডির ভেতরে সাংবাদিকতা করাকে সহজ ভাষায় ‘ট্রমা কাভারেজ ‘ বলছি। “ট্রমা-ইনফর্মড জার্নালিজম” একটি অপেক্ষাকৃত নতুন শব্দ, যদিও ট্রমাকে কভার করা — ঝড় এবং আগুন, ভূমিকম্প থেকে শুরু করে যৌন নিপীড়ন এবং হত্যাকাণ্ড থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ও যুদ্ধ — সবসময় সাংবাদিকদের কাজের একটি অংশ। ট্রমা রিপোর্টিং গুরুত্বপূর্ণ কোন গল্প বলা ভাল, কিন্তু সেটি যেন ক্ষতি ডেকে না আনে। কোভিড-১৯ কাভার করার সময় অপ্রস্তুত সাংবাদিকরাই কোভিডে আক্রন্ত হয়েছিলেন। ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি করার ঝুঁকি নেবার কারণে কোন কোন টেলিভিশন তাদের রুটিন সম্প্রচার বন্ধ রেখেছিলো। অনেক গণমাধ্যমকর্মীকে অফিস ছেড়ে ঘরকেই অফিস বানাতে হয়েছিল।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষায় এটি পুরোনো ইস্যু হলেও সাংবাদিকতায় নতুন। সাম্প্রতিককালে সাংবাদিকতার প্রসঙ্গে “ট্রমা-ইনফর্মড” শব্দটি বহুল আলোচিত । সাধারণভাবে, ট্রমা-অবহিত করার অর্থ হল যে ট্রমা সাধারণ এবং লোকেরা তাদের জীবনের কোনও সময়ে গুরুতর ট্রমা অনুভব করতে পারে।চিকিৎসক সম্প্রদায় ট্রমা এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বুঝতে শুরু করার পরে ট্রমা-অবহিতকরন অনুশীলনগুলি প্রথমে ওষুধে হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
যদিও সাংবাদিকদের কাছে একটি গাড়ি দুর্ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে রুটিনকাজ। এমন কিছু কিছু দূর্ঘটনার গল্পো সাংবাদিকদের চরম দুর্ভোগ বা মর্মান্তিক মৃত্যুর আভাস দিতে পারে। এই সমস্ত অভিজ্ঞতা – বিশেষ করে যখন সেগুলি মানুষের সহিংসতা এবং দূষিত অভিপ্রায় জড়িত থাকে – শিকার হওয়া , এমন কোন ভয়ংকর দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া, প্রিয়জনদের হারানো, সেইসাথে তাদের সেসব গল্প তুলে আনার প্রচেষ্টা সাংবাদিকদের জন্য যথেষ্ট মানসিক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে। যেমন ‘বিএম ডিপোর বিস্ফোরণেন ঘটনা ‘ – এটি যারা ঘটনাস্থলে বা মেডিকেলের মর্গে দেখেছেন, প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তাদের অনেকেরই মানসিক জটিলতা তৈরি হয়েছে।
সব ধরনের মানুষের কাছে ট্রমাটিক দূর্ঘটনার প্রভাব একরকম নয়৷
ট্রমা এবং আঘাতজনিত চাপে মানুষ ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ কেউ ঝামেলা ছাড়াই এমন ভয়াবহ দূর্ঘটনার দৃশ্য মোকাবেলা করার মানসিক শক্তি রাখেন। অনেকে ট্রমাকে কষ্টদায়ক মনে করবে, কিন্তু সময়ের সাথে এটি মোটামুটি দ্রুত কাটিয়ে উঠবে – সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যে। তবে একটি সংখ্যালঘু – সাংবাদিক, ভিডিওগ্রাফার এবং প্রোগ্রাম নির্মাতারা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত – তাদের জন্য এমন দূর্ঘটনার গুরুতর শারীরিক এবং মানসিক কষ্টের কারণ হতে পারে । এমন শারিরীক বা মানসিক জটিলতা তৈরি হওয়া সেটি সহকর্মীদের কাছে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে খোলামেলা হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে লজ্জা বা লজ্জিত হবার কিছুই নেই।
সাংবাদিকদের একটি প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে বা কোন গল্প বলার জন্য স্ক্রিপ্ট তৈরি এবং আঘাতমূলক ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের দৃশ্যায়ন, তাদের বক্তব্য নেবার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ, মানসিকভাবে শক্তিশালী, চলমান এবং প্রভাবশালী হতে হবে। বাইনেমে একটি স্টোরি প্রকাশিত হওয়ার তাড়না থাকা খারাপ কিছু নয়, তবে এটি নিজেদের সুস্থতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত নয়। এর অর্থ হল সাংবাদিকদের অবশ্যই তাদের সোর্সের অভিযোগগুলিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে এবং তাদের দেয়া তথ্যগুলো দিয়ে সাজানো রিপোর্ট কেবল একটি বাইলাইন পাওয়া বা সুপারড্রাইভ ব্যস্ততার জন্য, ভাইরাল হবার জন্য ব্যবহার করলে চলবে না। এমন গল্পো তৈরি করতে নিজেকে সকল অহংবোধ থেকে দুরে রাখুন । কারণ আপনি হয়তো কারো জীবনের সবচেয়ে খারাপ দৃশ্য বা খারাপ দূর্ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছেন, বিভৎস কিছু শুনতে যাচ্ছেন। সাংবাদিক হিসেবে কখনই কোন ভয়ংকর বিষয় বা সংবাদের সোর্সকে বা ভুক্তভোগীকে শক্তিহীন মনে করা যাবে না৷
ধর্ষণ, যৌন নিপিড়ন বা শিশু ধর্ষণ এই বিষয়গুলি সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করার সময়, একজন নাবালককে সনাক্ত না করার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এমনভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করতে হবে, বিশেষ যত্ন নিতে হবে যাতে সেই শিশুর পরিচয় প্রকাশ করে এমন বিশদ বিবরণ প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত না হয়। এবার ভেবে দেখা উচিত গণমাধ্যমে গণহারে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর ধর্ষণ বা যৌন নিপিড়নের খবর প্রকাশিত হবার পর সমাজে কেমন ট্রমা তৈরি করেছে। সাধারণভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতন্ক তৈরি হয়েছে। শিশুদের মনে শিক্ষক সম্পর্কে বিরুপ ধারনা তৈরি হয়েছে। এইভাবে শিশুর ছবি বা পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে সমানভাবে ইথিক্স ব্যবহার করা উচিত। নিশ্চিত করুন যে আপনার রিপোর্টিং যৌন নিপিড়নে অসাবধানতাবশত সম্মতি বা শিশুদের বা অভিভাবকদের মানসিক ট্রমার কারণ না হয়। অনেক সময় শিশুদের জবাই করে হত্যার সংবাদ অন্য মা-বাবার মধ্যেও ট্রমা তৈরি করে, নিজেদের শিশুর পরিবর্তিত দৃশ্য কল্পনায় আসে।
পরিবর্তন করে না। শিশু নির্যাতন এবং হত্যার বিষয়ে রিপোর্ট করা উচিত প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের মধ্যে বিকাশগত পার্থক্যের কথা মাথায় রেখে। প্রায়ই আমরা দেখি হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শি বা সহপাঠী হিসেবে অন্য শিশুর স্বাক্ষাৎকার প্রচার করা হচ্ছে। শিশুটির কোন বন্ধুর ভয়ংকর মৃত্যুর এই সংবাদ হয়তো তার পরবর্তী জীবনে ট্রমার কারণ হতে পারে। এমনকি পরিপক্ক-আদর্শ যুবক এবং এর ফলে বয়সের ক্ষমতার পার্থক্যগুলিকে বিবেচনা করা উচিত।
শব্দচয়নে সতর্ক হতে হবে । যেমন প্রতিবেদনে শিশু-কিশোরকে “অপ্রাপ্তবয়স্ক” হিসাবে বর্ণনা করা উচিত নয়। প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে “যৌন সম্পর্ক” এটি ট্রমাটিক বর্ণনার অপব্যবহার।
টিভি সাংবাদিকরাও উচ্চারিত শব্দে এমন অপব্যবহার এড়িয়ে চলুন। এর পরিবর্তে, অযৌক্তিক বিবরণ এড়িয়ে সময় পরিষ্কার, ধর্ষণকারীর সঠিক বর্ণনা ব্যবহার করুন। খুব সহজে যদি বলি “অসম্মতিমূলক যৌনতা” এর মতো শব্দের পরিবর্তে “ধর্ষণ” ‘ ব্যবহার করার কথা বলা হয় এইকারণে । এমন কোন ঘটনার বর্ণনায় বলাৎকার শব্দের ব্যবহার থাকলেও এতে আমার তুমোল আমার আপত্তি আছে।
কোন অপরাধমুলক কাজে জড়িত শিশুদের ছবি ব্যবহার, ধর্ষিতার ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনেকক্ষেত্রে প্রতিবেদন তৈরির সময় গাড়ির নাম্বার প্লেট ব্লার করা হয় – প্রত্যেকটি বিষয়ের পেছনে উদ্দেশ্যই হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা দেয়া।এছাড়া, শিশু কিশোরদের কোর্টে উপস্থাপন করা হলেও ; ছবি ব্লার করার কথা বলা হয়ে থাকে- কারণ অপ্রাপ্তবয়স্ক হবার কারণে ছবি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া শিশু কিশোর বা কিশোরীর মানসিক পরিপক্বতা তৈরি হয়নি। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা সংবাদকর্মীদের দায়িত্বশীল আচরন করতে হবে।