22 C
Dhaka
Thursday, February 13, 2025
More

    পানির অভাবে মারা গেছে ঐতিহ্যবাহী বড়াল ও মুসা খাঁ নদ

    আরও পড়ুন

    ::: আল আমিন,নাটোর প্রতিনিধি:::

    সব নদ-নদীই ইতিহাস সৃষ্টি করে। আর সে নদ-নদীর ইতিহাস জানতে আমরা সবাই আগ্রহী হয়ে উঠি। যদি সে নদ-নদী হয় আমাদের আপনজন, তাহলে তো কথাই থাকেনা। তেমনি নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার বাসিন্দাদের সাথে বড়াল নামটি এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, বড়াল নামটি শোনার সাথে সাথে ছোটবেলার বহু স্মৃতি মনের অজান্তে চোখের সামনে ভেসে উঠে।

    বর্ষার পানি নামার সাথে- সাথে নদীতে দিনভর লাফালাফি, মাছ ধরা, নৌকা চালানো, চাষীদের পাট জাগ দেওয়া। এরকম আরো বহু ঘটনা প্রত্যেককের মনকেই আলোড়িত করে। অনেকেই স্মরণ করতে পারবে স্কুলে পড়ার সময়গুলোর কথা। স্কুলে টিফিনের সময় নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নৌকা দেখা আবার মাঝে মাঝে নৌকার পাটাতনে উঠে বসে থাকা। মাঝিদের সাথে ভাব জমানো। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঢেউ গোনা। কখনো বা নৌকার সাথে সাথে দৌঁড় লাগানো। আর যাদের বাড়ি নদীর তীরে তাদের স্মৃতি তো আরো মধুর।

    যারা এখন প্রায় সত্তোর বছরের কাছাকাছি বা তারও উপরে তারা বড়াল সমন্ধে আরো বহু কিছু বলতে পারে। কারণ সেই সময়ে বড়ালের যৌবন ছিলো। যত সৌন্দর্য বড়াল অর্জন করেছিলো তা সেই সময় উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বড়ালের আগের অবস্থা আজ আর নেই। যৌবন হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন বড়ালের বুকে চাষ হচ্ছে ধান, গমসহ বিভিন্ন ফসল। দখল-দূষণ আর অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নদীর বুকে পলি জমে উঁচু হয়েছে। দখল আর দূষণের কারণে দুই পাড় চেপে গেছে। ফলে খরস্রোতা বড়াল নদী আজ শুধুই স্মৃতি।

    এতে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। দখল-দূষণ আর ভরাটের কবলে পড়া নদ রক্ষার দাবি জানিয়েছে সমাজকর্মীরা। নদ রক্ষায় পৃথক বরাদ্দেরও দাবি করেছেন তারা। জানা যায়, বাগাতিপাড়া উপজেলাটি বড়াল নদের মাধ্যমে দ্বিখন্ডিত হয়েছে। বড়াল নদের উৎপত্তি পদ্মা নদীর রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলায়। বড়াল নদের দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার।
    এটি রাজশাহীর চারঘাট, নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া, লালপুর, বড়াইগ্রাম, নাটোর সদর, গুরুদাসপুর হয়ে পাবনা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনায় মিশে গেছে। এক সময় এ নদ ছিল নৌ-যোগাযোগের প্রধান পথ। বর্ষা মৌসুমে সীমিত আকারে নদের মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে মালামাল আনা-নেয়া করা হলেও শুকনা মৌসুমে নদে পানি কমে যাওয়ায় যোগাযোগের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

    এক সময় এই নদে অনেক মাছ পাওয়া যেত। এখন নদ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মাছ পাওয়া যায় না।

    অন্যদিকে উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া গ্রাম থেকে উৎপত্তি হয়ে মুসা খাঁ নদটি উপজেলার ত্রিমোহনী, পকেটখালি, চারঘাটের ওমর গাড়ি দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উৎস থেকে নদটি চারঘাট-বাগাতিপাড়ার সীমানা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। জানা যায়, পূর্বে এটি নারদ আর বড়ালের সংযোগ রক্ষাকারী একটি খাল ছিল। পরে ১৮৩৮ সালে পদ্মা নদীতে বন্যার পানির বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। আর এভাবেই নদের মর্যাদা পায় মুসা খাঁ খাল। কিন্তু মর্যাদা পেলেও এ নদটিরও একই অবস্থা। স্থানীয় কৃষকরা জানান, কৃষকদের পৈতৃক জমির সঙ্গে সংযুক্ত বড়ালের চরে জমিতে কৃষি আবাদ ধান, পেঁয়াজ, ভুট্টার মতো ফসল চাষ করেছেন। নাব্যহীনতা ও নদের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন নদগুলোর জেলেরা। স্থানীয় জেলেরা জানান, এক সময়ে এই বড়াল নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হলেও এখন আর নদীতে মাছ শিকার করা হয় না। পানি না থাকায় তারা আজ অন্য পেশায় চলে গেছেন। পদ্মার মুখে পলি মাটি জমে পানির প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড়াল আজ নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা রেজাউন্নবী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৮১-৮২ অর্থ বছরে নদীর তীরবর্তী উপজেলাগুলোকে বন্যামুক্ত করার জন্য নদের উৎসমুখ চারঘাটে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়।
    এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে সুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্রমান্বয়ে বড়াল নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে।

    বাগাতিপাড়া মহিলা ডিগ্রী কলেজের মনোবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রশিদ বলেন, নদে পানি না থাকায় এ নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলো তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সেচসহ প্রতিদিনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। এখনই সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে এ নদটি পুণঃখনন করা না হলে বড়াল নদ একদিন হারিয়ে যাবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শুধু বড়ালের গল্প শুনে আর স্বপ্ন দেখে দিন কাটাবে।

    এ বিষয়ে নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, বড়াল নদী অববাহিকায় পানি সম্পদ পুনরুদ্ধার শীর্ষক ২ হাজার একশত বাহান্ন কোটি টাকা ব্যায়ে একটি প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে বড়াল নদের একশত তিপান্ন কিলোমিটার এবং মুসা খা নদের প্রায় ছয় কিলোমিটার পুনঃখনন করা হবে।

    এইবাংলা/ হিমেল

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisement -spot_img

    সবশেষ খবর