::: রাহাত আহমেদ :::
নির্মাণ সামগ্রীর আকাশছোঁয়া দামের কারণে দেশে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হবার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন বিভাগের ঠিকাদাররা ‘ রেইট রিসিডিল’ করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের বন্ধ থাকা কাজ শুরু করতে ইতিপূর্বে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে মানববন্ধনও করেছে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপদ বিভাগের তালিকাভুক্ত ঠিকাদাররা।
কিছুতেই কাজ হয় নি বরং দেশে প্রতি টন রডের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের ইতিহাসে এটিই রডের সর্বোচ্চ দাম। রডের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে নির্মাণ ব্যয় আরও বাড়বে। এতে করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের চলমান কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার, আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ।
নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িতরা জানান, শুধু রড নয়, গত কয়েকদিনে সিমেন্টের দামও অনেক বেড়েছে। কোম্পানিভেদে ৫০ কেজির এক বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা।বাংলাদেশ চলতি সপ্তাহে বাজারে আবারো সকল প্রকার রডের দাম বাড়িয়ে ১ কেজি রডের দাম ৯০.৫ টাকা নির্ধারন করা হয়েছিলো। যা আগের বাজার দর ছিলো ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। প্রতি কেজি রডের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পায়।
খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামালের দাম আগের তুলনায় অনেক তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণে রড উৎপাদনে আগের চেয়ে অনেকটা বাড়তি খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের প্রতিটি রড উৎপাদন কোম্পানি তাদের রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে আগের দামে রড আর কিনতে পাওয়া যাবে না। গ্যাস বিদ্যুৎসহ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রডের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে উৎপাদকেরা জানিয়েছেন। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস–বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি মূল্য পরিশোধ, তুরস্কের ভূমিকম্পের পর বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম আরেক দফা বৃদ্ধির কারণে রডের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাতে গ্যাস–বিদ্যুৎ ও ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাঁধে এসে পড়েছে।
বুধবার (১৫ মার্চ) বিকেল থেকে খুচরা বাজারে এক লাখ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন রড। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাঁচ মাসের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ১৪-১৫ হাজার টাকা। ডলার সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের মূল্যবৃদ্ধি, ফ্রেইট চার্জ এবং ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে রডের বাজারে। ১৬ মার্চ থেকে নতুন করে রডের বাজারে শীর্ষস্থানীয় তিনটি কোম্পানি প্রতি টন রডের দাম ৫০০ টাকা করে বেড়ে যায় । তাতে খুচরা পর্যায়ে নির্মাণ উপকরণটির দাম প্রথমবারের মতো লাখ টাকায় পৌঁছায়। নির্মাণ মৌসুমের শেষ দিকে এসে রডের দাম আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। তিনটি কোম্পানির রডের দাম প্রতি টন এক লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর আগে কখনোই লাখ টাকায় রড বিক্রি হয়নি বলে উৎপাদকেরা জানিয়েছেন।
রড ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি টন সাধারণ গ্রেডের (৪০০ ওয়াট) এমএস রড বিক্রি হতো ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকায়। সে বছরের শুরুতে বিক্রি হয়েছিলো ৪৭ থেকে ৪৮ হাজার টাকা। একই বছর ৬০ গ্রেড প্রতি টন বিএসআরএম রড বিক্রি হয় ৫৯ হাজার টাকা। কেএসআরএম বিক্রি হতো ৫৮ হাজার, একেএস ব্র্যান্ডের রড ৫৭ হাজার ৮০০ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে রডের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত দামের এই ধারা বজায় থাকলেও এখন দামের লাগাম টানা সম্ভব হয় নি।
গেল ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মিলে প্রতিটন প্রিমিয়াম মানের (৭৫-গ্রেড) রড বিক্রি হয়েছে ৯১,০০০ থেকে ৯৪,০০০ টাকায়, অথচ এক সপ্তাহ আগেও এর দাম ছিল ৮৭,০০০ থেকে ৮৯,০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত । ৬০ গ্রেডের রডের দামও ৮৪,০০০-৮৬,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৯,০০০-৯১,০০০ টাকা হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে।
যদিও গত বছরের মার্চে টনপ্রতি ৯২,০০০ টাকায় পৌঁছানোর পর থেকে রডের দাম ছিল কিছুটা নিম্নমুখী ছিলো। কোভিড-১৯ এর বিধিনিষেধ কাটিয়ে প্রথমবারের মতো বাজার স্বাভাবিক হওয়ার পর ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় প্রতিটন রডের দাম ছিল ৫৫,০০০ টাকা থাকলেও এখন সেটি লাখ ছুঁয়েছে।
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কারখানা মালিকরা বলছেন, গত দুইমাস ধরে বিশ্বব্যাপী রড তৈরির স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে, আর এর একটি বড় অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এছাড়া, চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতেও স্ক্র্যাপের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিএসআরএমের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘ব্যবহৃত স্ক্র্যাপ স্টিলের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করা হয়। মার্কিন ডলারের উচ্চ মূল্য এবং সাম্প্রতিক জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।’
এদিকে,রড সিমেন্টের দামের লাগাম টানতে না পারার কারণে বিভিন্ন সংস্থায় চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ বা ধীরগতি করে রেখেছে ঠিকাদাররা।
চট্টগ্রাম এলজিইডি ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান টিটু বলেন, ‘ রডের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে আমাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আমরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছি। সরকারি কাজ না করেও উপায় নেই। সরকার রডের দাম না কমালে আমাদের জায়গা-জমি বিক্রি করে পথে বসা ছাড়া উপায় নেই। ‘
এইবাংলা/তুহিন