::: বিশেষ প্রতিনিধি :::
দুবাইয়ে সোনার দোকান চালু করে আলোচনায় আসা আরাভ খানের বিচরন ছিলো কক্সবাজারের ইয়াবা সাম্রাজ্যে। জানা যায়, পুলিশ হত্যা মামলার আসামি রবিউল ওরফে আরাভ খানের যাতায়াত ছিলো কক্সবাজারের ইয়াবা অধ্যুষিত এলাকা টেকনাফে। কক্সবাজার শহর জুড়ে তার বেশ কিছু লোকজন ইয়াবা কারবারের ফরমায়েশ কাটতো। কক্সবাজার শহরের কিছু যুবককে সাথে নিয়ে ইয়াবা বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন আরাভ খান। দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান খুলে তাক লাগিয়ে দেয়া আরাভ খানে কক্সবাজারে আনাগোনা সম্পর্কে মিলেছে নানা তথ্য৷
সুত্রমতে, দীর্ঘদিন ধরে আন্ডারগ্রাউন্ড এক মাফিয়া কোটিপতির কেয়ারটেকার হিসেবেই কাজ করেছেন তিনি। সেই নেপথ্য গডফাদারেন স্বর্ণ ও ইয়াবা চোলাচালানের দেখভাল করার দায়িত্ব তাকে পৌঁছে দিয়ে সফলতার শীর্ষে।
কক্সবাজার শহরের বাহারচড়া এলাকার সেফায়েত হোসেন জয় নামের এক তরুনের সাথে আরাভ খানের সখ্যতার বিষয়ে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সুত্রমতে, জয় এবং জসিম নামের আরেক যুবকের সাথে আরাভ খানের সখ্যতার পেছনের কারণ ছিলো টেকনাফে ইয়াবা কারবারিদের আত্নসমর্পণ। মাদক বিরোধী অভিযানের পর ক্রস ফায়ারের ভয়ে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আত্নসমর্পণের মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কৌশল হিসেবে ইয়াবা বাণিজ্যের হোতাদের অনেকেই নিজেদেরকে পুলিশ হেফাজতে নেন। পুলিশ তৎকালীন এক উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে মধ্যস্থতান মাধ্যমে ইয়াবা বাণিজ্যের সাথে জড়িত বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে আত্নসমর্পণের সুযোগ করে দেবার ইস্যুতেই কোটি কোটি লেনদেনের মধ্যমনি ছিলেন রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। সোহাগ মোল্লা নামে তখন তিনি নিজের পরিচয় দিতেন।
সুত্রমতে, আরাভ খানের মধ্যস্ততায় দেশের একজন শীর্ষ ইয়াবা কারবারিকে দুবাই থেকে আত্নসমর্পণের জন্য দেশে আনা হয়। সেই ইয়াবা কারবারিকে আত্নসমর্পণের সুযোগ দেবার জন্য বড় অংকের আর্থিক লেনদেন করা হয়েছিলো। কিন্তু নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে শেষ পর্যন্ত দুবাই থেকে আনা এনে চুক্তি অনুযায়ী টাকা আদায় করার পরে তাকে ক্রসফায়ার দেয়া হয়।
জাতীয় তথ্য ভান্ডারে সুরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী জাতীয় পরিচয় পত্রে আরাভ খানের নাম রবিউল ইসলাম। এনআইডিতে আরাভ খানের পিতার নাম মতিউর রহমান, মায়ের নাম লাখি এবং স্ত্রীর নাম রুমা।
সুত্রমতে, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান গ্রেফতারী পরওয়ানা মাথায় নিয়ে অবাধে দেশে ফিরেছেন। এসেছেন কক্সবাজারেও৷ তার বাংলাদেশি পরিচয়পত্র থাকলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও ২০২২ সালে মার্চ এবং গেল ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে আরাভ তার উপস্থিতির কথা জানানও দিয়েছিলেন।
হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী আরাভ খানকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলের কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা বলা হলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথেই তার সখ্যতা প্রমাণ মিলেছে। এক বছরে বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে ভিসাও সংগ্রহ করেছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
কক্সবাজারের একাধিক সুত্র রবিউল ওরফে আরাভ খানের কক্সবাজার কানেকশনের কথা নিশ্চিত করেছেন। পুলিশ পরিদর্শক হত্যা মামলার আসামি হবার আগে থেকেই কক্সবাজার কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা দেখাশোনা করেছেন আরাভ। সিন্ডিকেটের হয়ে মডেলিং ও চলচিত্র শুটিং দলের সাথে উঠতি বয়সী তরুন তরুণীদের ব্যবহার করে কক্সবাজার থেকে ঢাকা পর্যন্ত মাদকের চালান পোঁছে দেবার বিষয়টিও দেখভাল করতেন তিনি। জানা গেছে, আরাভের সাথে সখ্যতার তালিকায় ছিলো সাজ্জাদ শরীফ, বাবু, আজাদুর রহমান, এহসানুল করিমসহ বেশ কিছু তরুনের নামও। এরমধ্যে এহসানুল করিমের বাড়ি চট্টগ্রামে।
দুবাইয়ে বসবাসরত এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, দেশ থেকে পালিয়ে রবিউল ইসলাম প্রথমে ভারতে চলে যান। সেখানে আরাভ খান নামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে পৌঁছেন দুবাইয়ে। পুরো কাজটিতে তাকে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাই সহযোগিতা করেছেন।
এনআইডির তথ্য অনুযায়ী রবিউলের পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। তার জন্মস্থান বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া ইউনিয়নে। ২০১৮ সালে ৭ জুলাই ঢাকায় পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান খুন হন। সেই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছাড়তে হয় তাকে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে একাধিক একাউন্ট ও নাম পরিবর্তন করেছেন।ফেসবুকে রবিউলের দাবি তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায় রবিউল এসএসসি পরীক্ষাও পাস করতে পারেননি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, ফেসবুকে সোহাগ মোল্লা, আপন ও হৃদয় নাম ব্যবহার করেছেন রবিউল। ২০০৯ সালে খোলা আরেকটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেটিতে তিনি ‘শেখ হৃদি’ নাম ব্যবহার করেছেন।
দেশ থেকে পালিয়ে রবিউল ইসলাম প্রথমে আগারতলা সীমান্তে পাড়ি দিয়ে ভারত যান। সুত্রমতে, বর্ডার অতিক্রম করে তাকে ভারতে পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করেন ফেণীতে চাকরিরত একজন সহকারী সহকারী জর্জ। মামলার আসামি হবার পর গ্রেফতার এড়িয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার রাজপুর-সোনারপুর পৌরসভার ফরতাবাদ এলাকায়।
আসল পরিচয় গোপন করে বেশ কিছুদিন ফরতাবাদ এলাকার উদয় সংঘ ক্লাবের পাশের একটি বস্তিতে ছিলেন তিনি। সুত্রমতে, ভারতের পাসপোর্ট হাতে পাবার আগ পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দা জাকির খানের ভাঙাচোরা বাসার দোতলায় মাসিক ২ হাজার রুপি ঘর ভাড়ায় নি থাকতেন রবিউল ওরফে আরাভ এবং তার স্ত্রী সাজেমা নাসরিন।
সুত্রমতে, দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান খুলে প্রকাশ্যে এলেও দীর্ঘদিন থেকেই স্থানীয় ইয়াবা কারবারি পক্ষে মিয়ানমারে ইয়াবা সরবরাহের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পৌঁছানোর কাছ করছেন তিনি। আন্তর্জাতিক হুন্ডি সিন্ডিকেটের হয়ে ইয়াবার মুল্য পরিশোধের চেইন গড়ে তুলেছিলেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কর্মরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে তার সখ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সেই সুত্রটি।
চট্টগ্রামের রিয়াজউদদীনের বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন দুবাই থেকে অবৈধভাবে দেশে আনা স্বর্ণের বারগুলো মুলত মুদ্রাবিহীন মুল্য পরিশোধের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে বার্মা হয়ে বিদেশ থেকে স্বর্ণের বার পুনরায় পৌঁছে যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই চেইনের মাধ্যমেই ইয়াবার মুল্য হতে শুরু করে অবৈধ বৈদেশিক বাণিজ্যের পেমেন্ট নিষ্পত্তি করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও চিতলমারীর স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রবিউল মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে ঢাকা এসেছিলেন চলচিত্রে নাম লেখানোর স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্নপুরন না হলেও হাল ছাড়েন নি তিনি। নানা কৌশলে মডেলিংয়ের জগতে প্রবেশ করেন।ধীরে ধীনর উঠতি বয়সি অনেক নারী মডেলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের টার্গেট করে ওই মডেলদের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন। এভাবে প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় ।একটি বেসরকারি টেলিভিশনের মালিকের ছেলেসহ মিডিয়ার অনেকের সাথেই তার সম্পর্ক তৈরি হয় মডেলিং জড়িত মেয়েদের যোগাড় করে দেবার ইস্যুতে। একপর্যায়ে মডেলিং থেকে প্রবেশ করেন অপরাধজগতে। জড়িয়ে পড়েন খুনসহ নানা অপরাধে। লোভী নারী মডেলদের ব্যবহার করা শুরু করেন স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানের বাহক হিসেবে। এই চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া আরেক বিতর্কিত নারী মডেলের। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের পরিচালক পরিচয় দেয়া অভিজাত এলাকায় দাপিয়ে বেড়ানো সেই মডেলও কক্সবাজার শহরে বেশ পরিচিত। তিনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন ।
কিভাবে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক বনেছেন রবিউল ওরফে আরাভ খান সেই বিষয়ে চেনা পরিচিতদের বিস্ময়ের শেষ নেই। তবে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের মানি লন্ডারিং শাখা ইতিমধ্যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু করেছে। কি ধরনের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন তিনি, কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন এবং তার উত্তানের নেপথ্যে কারা কারা ছিলেন, তা জানার চেষ্টা করবে সিআইডি।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় আরাভ নামের এক যুবকের হাজার কোটি টাকার সম্পদের বিষয়ে অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এসব আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।’
এইবাংলা/তুহিন