::: ওয়াহিদ জামান :::
সংবাদ, বহুল আলোচিত সাংবাদিকতাকে ছাপিয়ে যাবার মতো একটি বিষয় মৌলিক সাংবাদিকতা। বাংলাদেশে গণমাধ্যম যতোটা প্রযুক্তি নির্ভর হয়েছে মৌলিক সাংবাদিকতার বিষয়টি ততোটাই উপেক্ষিত হয়েছে। প্রতিবেদনের জনপ্রিয়তা কখনো মৌলিক সাংবাদিকতার মানদণ্ড হতে পারে না। তবুও মৌলিক সাংবাদিকতার বিষয়বস্তুর চেয়ে সাংবাদিকদের কাছে সংবাদের প্রচারই মুখ্য হয়ে উঠেছে। একইভাবে সংবাদের চোখ মানুষের উপরে নিবৃত্ত , সেলিব্রেটিদের ব্যক্তিগত জীবনে গণমাধ্যমের চোখ – ক্ষমতা বা ক্ষমতাসীনদের উপরে এখন সংবাদের চোখ নেই।
সাংবাদিকতা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পাবার পর সংবাদ গুনগত মানে পরিবর্তন এসেছে সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই ; কিন্তু মৌলিক সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে সাংবাদিকরা অনেকখানি দুরে চলে গেছে। সংবাদ ও সাংবাদিকতা কতোখানী ক্ষমতা ও প্রভাবশালীদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পেরেছে সেটিই সফলতা ব্যর্থতার মাপকাঠি হওয়া উচিত। একটি প্রতিবেদনে তার নিজস্ব লেন্স থেকে পুরোপুরি বিষয় চিত্রায়নের মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছে দেন, যাতে পাঠক বা দর্শকরা আবিষ্কার করে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে এবং সঠিক, সত্য-ভিত্তিক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং মানবতার ভিত্তিতে কাজ করা সাংবাদিকদের উপর নির্ভর করার কথা। কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না। প্রেস বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন ছাড়া ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো দায়বদ্ধতা না থাকার কারণে সাংবাদিকদের কাজের পরিধি কমে যাচ্ছে৷ একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাংবাদিকদের তাদের নিরাপত্তার ভয় ছাড়াই এমন সংবাদ পরিবেশন করতে সক্ষম হওয়া উচিত। হোক তা অন স্পট, ডিজিটাল মাধ্যমে বা ভার্চুয়াললি- যাই হোক না কেন।
ইউনিক সংবাদের গল্পগুলি প্রায়ই সামাজিক- এবং আত্ম-সমালোচনার লেন্সের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে সাংবাদিকের ব্যক্তিত্ব এবং তার প্রতিবেদনের বিষয়গত সত্যগুলি প্রায়শই গল্পের প্রকৃত “তথ্যের” চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়।আর জনপ্রিয়তার খোঁজে তৈরি করা প্রতিবেদন প্রায়শই গল্পোকে একটি অতিরঞ্জিত বা অপবিত্র দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যায়। এমন সংবাদ বা স্টোরীর টোন, শৈলী- সাংবাদিকতা হাস্যরস – ব্যঙ্গকে আলিঙ্গন বাধ্য করে। সমসাময়িক সাংবাদিকতায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্থক্যের অস্পষ্টতাকে বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ এবং পেশাদাররা।
সাংবাদিকতা শিল্প গত দেড় দশকে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে যা সাংবাদিকদের পাশাপাশি সংবাদের পাঠক এবং দর্শক উভয়কেই প্রভাবিত করেছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো ডিজিটাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা পাঠক বা দর্শকদের সংবাদ পাওয়ার সহজলভ্য উপায়গুলিকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করেছে। এভাবে ক্রমবর্ধমান মেরুকৃত রাজনৈতিক আবহাওয়া অনেক সংবাদের উৎসকে ব্যাপক অবিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হওয়া গুজবকেও যেমন সংবাদ হিসেবে মনে করছে, তেমনিভাবে ইউনিক জার্নালিজমের বিষয় নির্ধারণকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে হালকা বিষয়গুলিই সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে বেশি সাম্প্রতিক সময়ে পরীমনি, মাহিয়া মাহী কিংবা হিরো আলমের বিষয় গণমাধ্যমে যতখানি প্রাধান্য ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে ততোটাই গুরুত্বহীন ঠেকেছে বিদ্যুৎখাতের দূর্নীতি। সাংবাদিকতার এমন ধারার প্রচলনকে আমরা হাইপারলোকাল নিউজ বলতে পারি — এমন সব খবর যেগুলো আশেপাশের এলাকা এবং বাসিন্দাদের ক্রিয়াকলাপের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। হাইপারলোকাল নিউজের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সম্প্রতি গাজীপুরে মামলার কারণে নায়িকা মাহীর কারাগারে ডুকা আর ছাড়া পাওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন। দিনভর এমন সংবাদ তৈরির ব্যস্ততায় নিশ্চিতভাবে সমাজে ন্যায়বিচার, নির্যাতন, দূর্নীতির অনেক খবর চোখের আড়াল হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হবার ট্রেডিশনে ব্যতিব্যস্ত জনগণও আর সংবাদ, সাংবাদিক, সরকার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করে না। মনে করে যে এই গণমাধ্যমও সরকারের মতো নাগরিকদের সর্বোত্তম স্বার্থে কাজ করছে না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে পাঠক বা দর্শকরা তাদের জন্য অবিলম্বে দরকারী বা যেমন খবর তারা চান- এমন খবর চায় যা তারা নিজের চোখে যাচাই করতে পারে।
এভাবেই গতানুগতিক ধারায় সংবাদ তৈরি করে সাংবাদিকরা তাদের কাজের ক্ষেত্রে গুরুতর ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। পরিসংখ্যান বলছে ২০১০ থেকে ২০২১ এসময়ের মধ্যে কারাবন্দী সাংবাদিকদের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। দুঃখজনকভাবে, সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা সাইবার ক্রাইমের অপরাধে কারাদন্ড কেবলমাত্র একটি।
আমাদের দেশে জনপ্রিয় সংবাদ এবং ‘কঠিন’ সাংবাদিকতার এই সম্ভাব্য ‘সমজাতীয়করণ’ সাংবাদিকদের পেশাগত মতাদর্শের উপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলতে দেখা যাচ্ছে। সাধারন জনগণের কাছে গণমাধ্যম সহজলভ্য হলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত বিষয়গুলো অবিশ্বাস্য ঠেকছে। তাদের দৃষ্টিতে, ট্র্যাজেডি এবং অপরাধের পাশাপাশি, সমস্ত বর্তমান স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ক্ষমতায় থাকা লোকদের বা সরকারের গল্প বলে। সাধারণ মানুষ সম্পর্কে নয় বা সরাসরি (বা স্পষ্টভাবে) তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সংবাদের গল্পো গণমাধ্যমে স্থান পাচ্ছে কদাচিৎ।
সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এবং সমগ্র সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, যা শুধুমাত্র যোগাযোগের ফর্মগুলিকে স্পর্শ করছে না, বরং সরকার এবং নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক পরিবর্তন করছে। পেশাদার গণমাধ্যম মাত্রই নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের জন্য আরও সুযোগ প্রদান করে। গণমাধ্যম মাত্রই ক্ষমতা পুনর্বন্টন করার ক্ষমতা রাখে। গণতন্ত্র সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া, অন্যায্য সামাজিক ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা থাকা এবং সরকারের আচরণের উপর নজরদারি করা- গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কাজ। এটি প্রথাগত মিডিয়ার অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মিডিয়া ও তথ্যকে গণতান্ত্রিক করে তোলে।