::: ওয়াহিদ জামান :::
ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ডামাডোলে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি ; সবকিছুকে ব্যয় বেড়েছে। নিম্ম মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের কাছে এ যেন এক দুর্বিষহ কাল পাড়ি দেবার আয়োজন। জীবন ধারনের বাড়তি ব্যয় মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। তাই সংকটকাল সামাল দিতে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরছে অনেক পরিবার। জীবনের জন্য অপরিহার্য মৌলিক উপকরণাদির আকাশচুম্বী দাম সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, একইসাথে আয় হ্রাস, মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্যহারকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে।
ঢাকায় পাঁচজনের পরিবার নিয়ে গত পনের বছর বসবাস করে আসছে রংপুরের মোহরম আলী।তিনি পেশায় ক্যাব চালক। বাড়তি খরচের ঝক্কি সামাল দিতে না পেরে দুই ছেলেমেয়ে, মা আর স্ত্রীকে নিয়ে চলতি মাসের শুরুতে রংপুরে ফিরে এসেছেন মোহরম আলী। মোহরম জানায়, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যখন লাগামহীন, তাল মিলিয়ে যানবাহন ও বাসাভাড়াও বেড়েছে, বিদ্যুৎ খরচও বেড়েছে – তখন শহুরে জীবনকে বিদায় জানাতে হয়েছে তাদের। ‘
একই অবস্থা সাভারের একটি গার্মেন্টসে কমপ্লাইয়েন্স বিভাগের কর্মকর্তা শিহাব উদ্দিনের। তিনিও স্ত্রী সন্তানসহ পুরো পরিবার রেখে এসেছেন ফেনির গ্রামের বাড়িতে। নিজে মেসে থাকছেন, ‘ কারণ বেতনের ৩৫ হাজার টাকায় পরিবারসহ চলছে না তারও। জানালেন, চাকরি ছাড়তে পারছেন না বলে করছেন। তবে পরিবারকে গ্রামে পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। মুদির দোকানের বাকি পরিশোধ করার তাগিদও রয়েছে। ‘
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করা নিম্নবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্তের অবস্থা অনেকটাই একই। জীবন চালানো যখন দায়, শহর ছেড়ে গ্রামে আসা ছাড়া কোন উপায় নেই । তবে সেরকম কোন স্বস্তি নেই গ্রামেও। কারণ নিত্যকার পণ্য কিনতে নাভিশ্বাস উঠেছে গ্রামের সাধারণ মানুষেরও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাইকারিতে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মোটা চালের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। যার প্রভাবে খুচরায় অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়ে মোটা ও সরু চালের দাম মানভেদে কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা কমেছে। মোটা চালের দাম কমায় স্বস্তি ফেরার কথা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে। স্বস্তি ফেরেনি কারণ একই সময়ে বেড়েছে তেল, চিনি, তরকারির দাম। আবার আতপ চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ৭ টাকা বেড়ে গেছে। মৌলিক প্রয়োজনের চাল ; যেটি দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য। চালের মতো খাদ্যপণ্যের দাম দেড় যুগে বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ গুণ।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ’র (টিসিবি) তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে শুধু ফার্মের ডিমের দাম বেড়েছে ১.১৫শতাংশ। একহালি ডিম এক সপ্তাহ আগে ৪২ টাকা থেকে ৪৫ টাকায় পাওয়া যেত। সেটিই চলতি সপ্তাহে ৪২ টাকা থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সাথে বয়লার মুরগির দাম ৯.৯ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ২৩০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও বয়লার মুরগর দাম ছিল ২১০ টাকা থেকে ২৩০ টাকা। ১০ ই মার্চ পেঁয়াজের দামেও লেগেছে আগুন। ১৬.৬৭ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকায়।সপ্তাহ আগেও পেঁয়াজের দাম ছিলো ২৫ থেকে ৩৫ টাকা। দাম বৃদ্ধির তালিকায় আছে আদা, ময়দা থেকে শুরু করে তেল, চিনি, মসলা অধিকাংশ নিত্যকার পণ্য।
গত বছরের অক্টোবরে সিপিডি তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, ‘ রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। বলা হচ্ছে এটি ‘কম্প্রোমাইজ ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা। প্রচলিত ১৯টি খাবারের ওপর ভিত্তি করে তারা এই তথ্য দেয়।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা বলছে, ২০১৯ সালেও একজনের উপার্জন দিয়ে চারজনের একটি পরিবার চালানো যেত ১৭ হাজার ৫৩০ টাকায় । খাবারের মেন্যু থেকে মাছ মাংস বাদ দিলে ওই পরিবারের খাবার খরচ হতো ছয় হাজার ৫৪১ টাকা।
নয় মাস আগের সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘরভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য ক্রয়, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, যাতায়াত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বিল হিসাব করলে ঢাকার আশপাশের এলাকায় চার সদস্যের এক পরিবারের মাসিক খরচ অন্তত ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা। আর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বাড়িভাড়া নিয়ে বসবাস করলে মাসিক খরচ হবে ৪৭ হাজার ১৮২ টাকা। খাবারের তালিকা থেকে মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি বাদ দিলেও সে অংক দাঁড়াতো ৩৩ হাজার ৮৪১ টাকায়। পরিবার প্রতি বিদ্যুৎ খরচ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্যের দাম বৃদ্ধির কারণে পাল্টে গেছে সেই পরিস্থিতিও।
নতুন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোফিন্যান্স অপরচুনিটিজের (এমএফও) সহায়তায় গার্মেন্ট ওয়ার্কার ডায়েরি নামের একটি প্রকল্পের আওতায় একটি জরিপ করা হয়েছিলো । সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সেই জরিপে উঠে আসে দেশের কোন জেলায় শ্রমিকদের পরিবারসহ জীবনযাপনের ব্যয় তাদের মজুরি দিয়ে নির্বাহ করা সম্ভব নয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম, ঢাকা সিটি, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকায় মোটামুটি চারজন সদস্যের একটি পরিবার পরিচালনায় (নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয়) ঢাকার জন্য ১৯ হাজার ২০০ থেকে ২২ হাজার ৯০০ টাকা, চট্টগ্রামের জন্য ২১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ২৬ হাজার টাকা এবং গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের জন্য ২২ হাজার ৯০০ টাকার প্রয়োজন। অথচ গড় উপার্জন ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত ছিল প্রায় ৯ হাজার ৯৮৪ টাকা। এর মধ্যে নারীদের আয় ছিল ৯ হাজার ৬৬৯ টাকা এবং পুরুষদের ছিল ১০ হাজার ৯২৮ টাকা।
নোয়াখালী বেগমগঞ্জ থেকে সাভারের একটি গার্মেন্টসে পাঁচ বছর চাকরি করে গ্রামে ফিরে এসেছেন আয়েশা ও আবু তৈয়ব। স্বামী স্ত্রীর সীমিত রোজগারে সাভারে বৃদ্ধা মা, দুই সন্তানের পরিবার চলছিলো না কোনভাবেই। তার উপর গার্মেন্টসে ওভারটাইম কমেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘ জীবনযাপনের ব্যয়ের হিসেব নতুন করে করতে হবে । জ্বালানির মুল্য বেড়েছে। গ্যাস বিদ্যুৎ সবকিছুর দামই বাড়তি ; এখন পরিস্থিতি অনেক খারাপ । মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যদিও সরকারের হিসেবে তা কম।’
ইতিমধ্যে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বয়লার মুরগির কাটপিস এবং কেজির চেয়ে কম পরিমানে মাংস বিক্রির খবর চাউর হয়েছে সবখানে। সংশ্লিষ্টদের মতে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় ‘আপসের মেন্যু’ বাজারের এমন চালচিত্রই বলে দেয় কেমন আছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্মবৃত্তের মানুষ।