:: ওয়াহিদ জামান :::
চট্টগ্রাম বন্দরের নিলাম শাখা থেকে কনটেইনার পাচারের অভিযোগ অনেকদিনের। অভিযোগ আছে চট্টগ্রাম বন্দরের অসাধু কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর যোগসাজশে একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে টার্মিনাল থেকে কনটেইনার পাচার করে আসছে। কখনও ধরা পড়লেও ; এই চক্রের বিরুদ্ধে চুরির মামলার মতো লঘু দন্ড দিয়েই দায় সারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। গেল বৃহস্পতিবার (৯ ই মার্চ)চট্টগ্রাম বন্দরের সাউথ টার্মিনাল থেকে অবৈধভাবে দুটি কনটেইনার বের করার সময় আটক করা হয়েছে আটজনকে। বৃহস্পতিবার সকাল আটটার ঘটনার একদিন পর বন্দরের নিরাপত্তা দপ্তরের মারুফ হোসেন নামের এক উপ পরিদর্শক ( এএসআই) মামলা দায়ের করেছেন নগরের ইপিজেড থানায়।
বন্দরের পরিবহন ও নিরাপত্তা বিভাগের কয়েকজন কর্মচারী ও আনসার সদস্য, কনটেইনার খালাসের সঙ্গে যুক্ত অপারেটররা মিলে জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যভর্তি কনটেইনার পাচারের সঙ্গে জড়িত। এই সিন্ডিকেটের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করার অন্তত ত্রিশ ঘন্টা পরে দায়ের করা হয়েছে ‘ চুরির মামলা’। সুত্রমতে, মামলার এজাহার থেকে বাদ দেয়া হয়েছে চক্রের আরও তিন সদস্যের নাম।
মামলায় আসামীদের মধ্যে বন্দরের পরিবহন বিভাগের নিম্নমান বহিঃসহকারী মো.আব্দুল হাকিম (৩৪), নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ের নিরাপত্তা রক্ষী কাজী আবু দাউদ (৪৮) এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা শাখায় পদায়ন হওয়া আনসার সদস্য অনুকুল বিশ্বাস (২৫) ও এনামুল হকের নাম রাখা হয়েছে চুরির মামলার এজাহারে । বাকি চারজন হলেন- লরিচালক ( টেইলার) জালাল উদ্দিন (২৩), আইয়ূব আলী (২৩) ও নাজমুল হোসেন (২৭) এবং চালকের সহকারী নুরুল ইসলাম (২০)।
একই মামলায় সাময়িক বরখাস্ত থাকা বন্দরের নিরাপত্তা পরিচালকের দফতরের নিরাপত্তারক্ষী মোজাম্মেল হোসেন রবিনের (৩৭) সঙ্গে কনটেইনার খালাসের যন্ত্রাংশ পরিচালনায় নিয়োজিত অপারেটরসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫-৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। মদভর্তি কনটেইনার পাচারের ঘটনায় এরআগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষী মোজাম্মেল হোসেন রবিন এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বদাতা বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মামলার এজাহার মতে, কোন ধরনের বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই টার্মিনাল থেকে তিনটি টেইলারে করে বের করা হচ্ছিলো বিশ ও চল্লিশ ফিটের দুটি পণ্যভর্তি কনটেইনার। বলা হচ্ছে একটি কনটেইনারে ২৫ টন প্লাস্টিকের দানা ও আরেকটিতে পাঁচ লাখ টাকার ফেব্রিকস ছিলো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভিন্ন দুটি কনটেইনার বের করা হয়েছে একই প্রক্রিয়ায় ; কিন্তু সেই বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ বন্দরের নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তারা৷
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের সাউথ টার্মিনাল থেকে ( গুপ্তখাল) বের করা অন্য দুটি কনটেইনারে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার পণ্য ছিলো৷ মামলার বাদি মারুফ হোসেনের দাবি রাস্তায় যানজটের কারণে তিনি কর্মস্থলে ডুকতে কিছুটা দেরি হয়। গেটে এসে টার্মিনাল থেকে বের করার জন্য তিনটি টেইলার দেখতে পান৷ প্রকৃতপক্ষে ঘটনাস্থলেই ছিলেন না মামলার বাদী উপ পরিদর্শক মারুফ হোসেন।
সুত্রমতে, জাল নথিপত্র দিয়ে কনটেইনার খালাসের চেষ্টার সঙ্গে বন্দরের কর্মচারী, আনসার সদস্য, লরিচালক, সহকারী মিলে এটা পুরো একটা চক্র জড়িত। সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকা বন্দরের নিরাপত্তারক্ষী নথিপত্র জমা না দিয়ে লরিচালকদের ইয়ার্ডে ঢোকার ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া বন্দরের কর্মচারী ও আনসার সদস্যদের যোগসাজশ আছে।
কেপিআইভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল থেকে কনটেইনার পাচারের এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার ধারা ( চুরি অভিযোগ) নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুত্রমতে, পেনাল কোর্টের ৩৭৯/৪১১/১০৯ ধারার মামলা দায়ের করে অপরাধী বাঁচিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনটি ধারাই সাধারণত ছিঁচকে চুরির মামলায় দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জর্জ কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট জেড এ মিনার বলেন, ‘ ধারাগুলো সাধারণত চুরির মামলায় ব্যবহার করা হয়। ৩৭৯/৪১১ ধারার মামলা দায়ের করার অর্থ হলো,যদি কোন ব্যক্তি অন্যের অজান্তে কোন জিনিস চুরি করেন তবে ৩৭৯ ধারায় মামলা দেয়া হয়,আর যদি উক্ত মালামাল সহ ঐ আসামীকে ধরা হয় বা গ্রেফতার করা হয় তবে ৪১১ ধারায় রিকভারি দেখানো হয় । ‘
এই আইনজীবী জানান, ‘ কার্যবিধি আইনের ১০৯ ধারার বিধান প্রয়োগ করে ১ বছর বা তার অনধিক সময়ের জন্য মুচলেকা সম্পাদনের আদেশ দিতে পারেন আদালত । এই ধারা মতে প্রদত্ত মুচলেকাকে সদাচরণের মুচলেকা বলা হয়। ‘
সুত্রমতে, প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়া টেইলার টার্মিনালে প্রবেশ করা, হ্যান্ডিলিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কনটেইনারগুলো টেইলারে তুলে দেয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়া কোনভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব নয়। এমন জালিয়াতি চক্রের সাথে বন্দরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা জড়িত। চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ ও সংশ্লিষ্টদের বাঁচাতেই চুরির মামলা করে দায় সেরেছে নিরাপত্তা বিভাগ। আর পুলিশ বলছে, বাদির ( বন্দরের নিরাপত্তা দপ্তরের এএসআই) টাইপ করা এজাহার অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে৷
ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, ‘ কনটেইনার আটক করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। কিন্তু কনটেইনারে কি ধরনের পণ্য ছিলো সেটি যাচাই করতে কিছুটা সময় লেগেছে। তবে মামলার আসামিদের নয়জনের মধ্যে আটজনকে আটক করা হয়েছে। লরিগুলো (টেইলার) যেসব প্রতিষ্ঠানের তাদের কেউ কনটেইনার পাচারে সম্পৃক্ততা আছে কি না সেটাও আমরা যাচাই করে দেখছি। ‘
ইপিজেড থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আবদল করিম বলেন, ‘আটজনকে গ্রেফতারের পর আমরা আদালতের নির্দেশে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বন্দরের কর্মচারী, আনসার সদস্য, লরিচালক, সহকারী মিলে এটা পুরো একটা চক্র, যারা জাল নথিপত্র দিয়ে কনটেইনার খালাসের চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত। সর্বশেষ যে দু’টি কনটেইনার বন্দরের ইয়ার্ড থেকে বের করে নেয়া হচ্ছিল, সেগুলোর জন্য কোনো নথিপত্রও দাখিল করা হয়নি। উল্টো বন্দরের এক নিরাপত্তা কর্মী বাধা দিলে তাকে মারধর করা হয়।’
এরআগে ২০১৯ সালে অবসরে যাওয়া দুই কাস্টমস কর্মকর্তার সচল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কয়েক হাজার কনটেইনার পাচার এবং পাঁচ শতাধিক কনটেইনার অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বদলি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টমসের তৎকালীন কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জামান।
নিলামের ‘ প্লাস্টিক দানা ‘
১০ মার্চ দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে একটি কনটেইনারে ২৫ টন প্লাস্টিক দানা ছিলো ; যার মুল্য ২৯ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরের নিলাম শাখা থেকে কনটেইনার পাচারের ঘটনা নতুন নয়। এরআগেও নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করা প্লাস্টিক দানার একাধিক কনটেইনার টার্মিনাল থেকে বের হবার পর নিলামকারী কাছে পৌছায় নি। এমন কি নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করা প্লাস্টিক দানার কনটেইনার নিলামকারীর কাছে না দিয়ে টার্মিনাল থেকে বের করে বাজারে বিক্রি করে দেবার অভিযোগও আছে।
নথি অনুযায়ী, নিলামের মাধ্যমে প্লাস্টিক দানার কনটেইনার ক্রয় করেছিলেন কাটা পাহাড় এলাকার মদিনা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান । এর বিপরীতে নিলামে বিড করা অর্থপরিশোধ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক। নিলামের সেই ডকুমেন্টস ব্যবহার করে নিরাপত্তা গেট দিয়ে প্লাস্টিক দানার কনটেইনার বের করার পরও সেই কনটেইনার পৌঁছেনি প্রতিষ্ঠানটির গুদামে। এবিষয়ে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন নিলাম শাখায়। সুরাহা হয় নি সেই অভিযোগেরও।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে কনটেইনার পাচারসহ বড় ধরনের অভিযোগ আছে এমন কাউকে যদি কোনভাবে সুরক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে । কারণ এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যাবে কেপিআই ভুক্ত বন্দরর জালিয়াতি বা দুর্নীতি করেও সুরক্ষা পাওয়া যায়। এতে কাস্টম হাউজ বা বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে। ‘
এই বিষয়ে পূর্বের প্রতিবেদন দেখুন