::: ওয়াহিদ জামান :::
কিসিঞ্জারের ‘বাসকেট কেস’ থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া টাইগার হিসেবে আবিভূত হয়েছিল অর্থনৈতিক শক্তির জোরে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তুমোল বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া বৃদ্ধি – সংকটে ফেলেছে পুরো অর্থনীতিকে৷ ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিসহ আমদানি অর্থ পরিশোধে ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধির কারণে দৃঢ় ও স্থিতিশীল অবস্থান থেকে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি।
গত ছয় মাসে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মূল্য ২৫ শতাংশের বেশি কমেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ শতাংশ।আইএমএফের দেয়া ঋণের শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশকে ভর্তুকি কমাতে হবে, যা শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিতই করবে। জ্বালানির দাম ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি এবং শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য হ্রাসের দিকে নজর দিতে হবে । ডলারের দাপটে বাংলাদেশি মুদ্রা, তথা টাকার মূল্য ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে জুঁতসই ব্যবস্থা নিশ্চিতের তাগিদ তাদের।
কোভিড-১৯ মহামারি ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে অতিরিক্ত ব্যয় এবং নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাওয়া খাদ্য আমদানির খরচ মেটাতে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও বিভিন্ন পাবলিক সেক্টর থেকে ঋণ নিয়েছে।বিশ্বব্যাংকের উদ্বেগ, ঋণের সুদ মেটাতে গিয়ে ইতোমধ্যেই এই দেশগুলোর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সহায়তা, এবং অবকাঠামো বিনিয়োগ খাতে অর্থ টান পড়ছে।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের মতে , ‘ দেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে এর চেয়ে আর খারাপ হবে না।আমাদের অর্থনীতির যে সহনশীলতা, সেটি অত্যন্ত গভীর। যেকোনো একটি ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পড়ে যাবে না। কভিডের সময় আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।’
২০২১ সালে ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ $ ৪৮.০৮ বিলিয়ন থেকে কমেছে আশংকাজনকভাবে। ইতিহাসে ভেঙে – চলতি বছরের ২রা জানুয়ারিতে $ ৩২.৭ বিলিয়নে নেমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ । এর মধ্যে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (EDF) জন্য প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কাকে ঋণ হিসেবে। এরমানে ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে মাত্র ২৪ বিলিয়ন ডলার হাতে রয়েছে। উপরন্তু, কিছু ডলারের রিজার্ভ মার্কিন ট্রেজারি বন্ড এবং সোনার রিজার্ভে বিনিয়োগের আকারে রাখা হয়। ফলে, বাংলাদেশ একটি গুরুতর বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মুখোমুখি ; এটি বলা অপেক্ষা রাখে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধান পাঁচটি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামও। ঋণসংকট, উচ্চ পণ্যমূল্যের ধাক্কা, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি ও সম্পদের জন্য ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির চরম ঝুঁকি হিসেবে দেখছে সংস্থাটি।
এর মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণও বাড়ছে, ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ মিটার ছুঁয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন ২০২৪ এবং ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি একটি বড় ধাক্কার সম্মুখীন হতে পারে ; যখন এটি বিশটি মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশী ঋণদাতাদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে।এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকার রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কর্ণফুলী টানেলসহ বিদেশি অর্থায়নে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চ সুদহার, ম্যাচ্যুরিং ক্যাপিটাল এবং ঋণের চক্রবৃদ্ধি সুদের কারণে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের জন্য নির্ধারিত পেমেন্টগুলো আরও উচ্চতর হতে পারে।
এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে জরাগ্রস্ত দেশের অর্থনীতি। ২০২১ সালে দেশের দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ৭০.০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে, যা এক বছর আগেও ছিল ৬০.৪১ বিলিয়ন ডলার।বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ২০১১ সালের ২৭.০৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৩৮% বেড়ে ২০২১ সালে দাঁড়ায় ৯১.৪৩ বিলিয়ন ডলার। ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেবট রিপোর্ট ২০২২’ শিরোনামের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ ভারতের বৈদেশিক ঋণ এই একই সময়ে বেড়েছে ৮৩%, পাকিস্তানের বেড়েছে ১০১% এবং শ্রীলঙ্কার ১১৯%।
রিস্কি ক্যাটাগরিতে আটকা পড়েছে ক্রেডিট রেটিংও। ২০১২ থেকে বাংলাদেশের ফিচ, মুডী, এস এন্ড পি রেটিং এজেন্সি গুলো বাংলাদেশকে BB- ব্যান্ডে রেটিং করে আসছে। গ্রীসের ঋণ খেলাফি হবার প্রেক্ষিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার সদস্য দেশ গুলোকে রেটিং ৬০% এর উপরে আনার নির্দেশনা দিয়েছে। অথচ লাগামহীন বৈদেশিক ঋণের হঠাৎ উচ্চ প্রবাহ বাংলাদেশের টিই রেটিং ৩০-৩৫% এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন নন ইনভেস্টমেন্ট ব্যান্ড (Non-investment grade speculative) TE-৪০, মুডি-BA3, ফিচ-‘ বিবি-A’ তেস্ট্যাবল ছিল, বর্তমানের ঋণ এই ব্যান্ডে নেগেটিভ স্ট্যাগ পাবার উপযোগীতা সৃষ্টি করেছে।
৪২ মাসের চুক্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে সরকার ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে । এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে বলেছে আইএমএফ। এছাড়া আইএমএফ এর নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাস্টেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, যারা এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে। ২.২ শতাংশ সুদে নেওয়া এই ঋণ আসবে সাত কিস্তিতে। কিস্তি শেষ হবে ২০২৬ সালে।
পৃথিবীতে এবারই প্রথম একসঙ্গে তেল, গ্যাস, কয়লা ও ফুড ইনফ্লেশন এই চারটি সংকট দেখছে মানুষ। বর্তমান সংকটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপসহ উন্নত সব দেশ, উন্নয়নশীল দেশ এমনকি আফ্রিকার গরীব দেশগুলোও কোনো না কোনোভাবে সংকটে পড়েছে।ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বৈশ্বিক এলএনজির দাম কয়েক মাসের মধ্যে ৮-১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। জ্বালানির দামও অনেক বেড়েছে। খাদ্যশস্যের দাম ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে মুদ্রার দাম কমে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এমতাবস্থায় আমদানি কমানো এবং সাশ্রয়ী হওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। মর্গ্যান স্ট্যানলির অর্থনীতিবিদদের মতে, ৪০ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকায় এবং মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তাদের চাহিদা ও দাম কমানোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে।
পরিসংখ্যান বলছে রপ্তানি ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচকই ভালো নেই। মূল্যস্ফীতি যখন ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তখনই প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি নেমেছে গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। একইভাবে রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্যঘাটতি এখন গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের যে ঘাটতি, তা-ও গত ৫০ বছরে দেখা যায়নি। এর প্রভাবে কেবল চলতি বছরেই টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে বাংলাদেশ ।