::: ওয়াহিদ জামান :::
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হঠাৎ অচেনা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর নানা তৎপরতা হঠাৎ করে প্রকাশ্যে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা চল্লিশ বিশ্ব নেতার খোলা চিঠিতে ড. ইউনুস ইস্যুকে প্রাধান্য দেয়া হলেও, এই চিঠির মুল উপজীব্য নির্বাচন ও গণতন্ত্র – বলছেন বিশ্লেষকরা।
এই চিঠিকে বছরের বেশি সময় ধরে সরকারের সাথে ঢাকাস্থ দূতাবাসগুলোর সমঝোতা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। নোবেলজয়ী ড. ইউনুস বাংলাদেশে সরকারের বিদ্বেষের কবলে পড়েছেন ; এমন তথ্য স্পষ্ট করা হয়েছে চিঠিতে। একই সাথে দেশের মানুষের উদ্ভাবন ও সাহসের প্রশংসাও করেছেন বিশ্বনেতারা। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য সুশাসন ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাঁধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বাংলাদেশে -সেটিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের প্রশংসাও বের হয়েছে বিশ্ব নেতাদের এই চিঠিতে। গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বাদ দিলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্য বিশ্বনেতারা স্বীকার করে নিয়েছেন।
হঠাৎ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ড. ইউনুস ইস্যুকে বিশ্ব নেতাদের এমন চিঠি কৌতুহল বাড়িয়েছে বৈকি। একই সাথে আলোচনার টেবিলে, রাজনৈতিক বচনের আড়ালে ফিসফাঁস শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এই চিঠিকে মোটেও আমলে নেবার পক্ষে নন। তারা বলছেন, ‘ ড. ইউনুস ইস্যুতে এই চিঠি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষেত্রেও কোন প্রভাব ফেলবে না ।’
এমনতেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা বাড়িয়েছিলো বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। তারা সরকারের গত কয়েক বছরের আমলনামা তুলে ধরে আসছিলেন কুটনৈতিকদের কাছে। বিশেষ করে দেশের ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক অবস্থা, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনাস্থা , মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মামলার বিষয়ে তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেছেন তারা। বিরোধী দলগুলো বহির্বিশ্বকে বোঝাতে চাচ্ছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা নেই। ফলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছিল বিএনপি। চল্লিশ বিশ্ব নেতার খোলা চিঠিকে প্রাথমিক সফলতা হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতারা। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও মনে করেন শুধু ড. ইউনুস ইস্যু নয়, দেশে গণতন্ত্রও সুশাসনের সংকট স্পষ্ট হয়েছে নানা ইস্যুতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল মনে করেন, ‘ বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের ও সুশাসনের সংকট রয়েছে। এই সংকট আগেও ছিল, এখন বেশি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, বর্তমান সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই, কোনো অ্যাকাউন্টিবিলিটি নেই। ‘
তবে চল্লিশ বিশ্ব নেতার চিঠিতে স্পষ্ট হয়েছে, ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ যখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন পৃথিবীর মনোযোগ আকর্ষণ না করলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং ভূরাজনীতির আলোচনায় বাংলাদেশ কোনো না কোনোভাবে যে উল্লেখ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া স্বাধীনতা অর্জনের অল্প কিছুদিন পরই বাংলাদেশকে একটি আন্তর্জাতিক ‘বাস্কেট কেস’ থেকে এখন উন্নয়নের পরীক্ষাগার হিসেবেই চিত্রিত করা হচ্ছে।
অর্থনেতিক প্যারামিটার বলছে , দেশে যে পরিমাণ মানুষ গরীব ছিল, তার সংখ্যা অনেকটাই কমেছে, বেড়েছে জিডিপিও৷ স্বাস্থ্য, শিক্ষাখাতেও বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে৷ গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরের কম, এখন সেটি ৭০ বছরের বেশি৷ বাংলাদেশের জন্য আনন্দের খবর হচ্ছে, স্বাধীনতার সময় অর্থনৈতিক ও সমাজিক সব সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে পিছনে থাকলেও, এখন প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ তাদের ছাড়িয়ে গেছে৷
একইসাথে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জন্য পররাষ্ট্র নীতির ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ইউক্রেনের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব এবং অন্যদিকে রাশিয়ার পক্ষে চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ভোটদানে বিরত থাকার মতো ভারসাম্যের নীতি গ্রহণ করলেও, চল্লিশ বিশ্ব নেতার খোলা চিঠির পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারসাম্য নীতিতে অটল থাকা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের জন্য। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে। বহির্বিশ্বে অর্থনীতি ও রাজনীতি অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্যে পড়েছে, এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া ঝুঁকি মুক্ত নয় বাংলাদেশও।
যদিও নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি বলেছিলেন, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রহীনতার মাঝেও একটি দেশ বা জনপদের অর্থনৈতিক উন্নতি হতে পারে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। এমনকি চরম দারিদ্র্যও হ্রাস পেতে পারে। কারণ দুর্নীতিপরায়ণ ও অগণতান্ত্রিক সরকারও তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধনে ব্যাপৃত হতে পারে।
বর্তমানে দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশও বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে গণতন্ত্র কোনো আবশ্যিক শর্ত নয়। এমনকি ব্যাপক দুর্নীতিও একটি দেশের উন্নয়ন বিঘ্নিত করতে পারে না। অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে অগণতান্ত্রিকতা ও দুর্নীতির সহনীয় মাত্রা কী পরিমাণ হতে পারে ; সেই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোন মন্তব্য নেই কারো।
কতটা দুর্নীতি ও অগণতান্ত্রিক চর্চা থাকলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে না। অথবা সীমাহীন দুর্নীতি এবং চরম অগণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে পারে কিনা।
মোটকথা, সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেড়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ বহির্বিশ্বের অনেক দেশ। ইতোমধ্যে সরকারকে এমন বার্তাও দিয়েছেন তারা। ফলে নির্বাচন ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে নানামহলের কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হবে নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক জট এখনো খুলেনি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ইতিবাচক দিকেই এগুচ্ছিলো দেশ,ঠিক তখনই ভিন্ন হাওয়া বইছে দেশের রাজনীতির মাঠে। সেই সাথে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চল্লিশ বিশ্ব নেতার খোলা চিঠি দেশের সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।