::: ওয়াহিদ জামান :::
বালুখালির রোহিঙ্গা ক্যাম্প রোহিঙ্গাদের জন্য অনিরাপদ প্রমাণ করতে চায় একটি সংগঠন। ক্যাম্পগুলো অনিরাপদ তকমা লাগাতেই কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করেছে ‘ আরসা’। গত ৪ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা সন্ত্রাসীদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে ৩৯ জন খুন হয়েছে। যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা নেতা বা মাঝি ছিলেন। তাঁরা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করছিলেন। এসব হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের তীর মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) দিকে।
গেলো বছরের ডিসেম্বর মাসে একটি খুনের মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয় মাদক কারবার নিয়ে আতাউল্লাহর সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী নবী হোসেন গ্রুপের দীর্ঘদিনের বিরোধের জেরে এই দুইজনকে হত্যা করা হয়েছে । মামলার এজাহারে আরসা নেতা আতাউল্লাহর ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছিল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুর কোনারপাড়া মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় সম্প্রতি আরসার দুই গ্রুপের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে।
সুত্রমতে, সৌদিআরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সাথে বাংলাদেশে অবস্থান করা ‘আরসা’ নেতাদের নিয়মিত যোগাযোগও রয়েছে। বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে নাশকতার ছক আঁকা হয়েছে কক্সবাজারে বসেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বকে পুঁজি করতে এমন কৌশল নেয়া হয়েছে বলে দাবি সুত্রটির।
নিয়মিত ক্যাম্পে যোগাযোগ করছে আরসার বেশ কিছু নেতা। মিয়ানমার থেকে স্থল পথে নিয়মিত টেকনাফে আসা যাওয়াও করছে তারা। ছদ্মবেশে কক্সবাজারের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলেই থাকেন আরসার নেতারা। সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে আর্থিক স্বচ্চ্ছলতা এসেছে ‘ অস্ত্র ও ইয়াবা’ পাচারের মাধ্যমে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত একাধিক রোহিঙ্গা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এমন তথ্য দিয়েছে। তারা দাবি করেছে ক্যাম্পে আগুন লাগানোর দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছে। চলতি সপ্তাহে কিছু অল্পবয়সী যুবকের ক্যাম্পে ডুকাসহ বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের দাবি এসব যুবক ও কিশোরদের এরআগে দেখা যায় নি ক্যাম্পে। তাদের অনেকেই আগুন লাগানোর ভিডিও ধারণ করেছেন নিজেদের মোবাইলে।
সুত্রমতে, দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে এমন তৎপরতার তথ্য ছিলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক রাখার পরও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের৷ সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও সাংবাদিকদের জানান, এমন সন্দেহের কথা৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা নাশকতা ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখছে সরকার।
বেশ কয়েকমাস ধরে উখিয়ার আশ্রয়শিবিরগুলোতে আতঙ্কে ভুগছিলেন শতাধিক রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা)। আরসার ক্রমাগত হুমকির কারণে এরই মধ্যে ৯০ জনের মতো মাঝি আত্মগোপনে চলে গেছেন। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েকজন মাঝিকে হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এমন আতঙ্ক তৈরি হয়।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে ছদ্মবেশে থাকা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে আতন্ক তৈরি করতে তৈরি করেছে মাঝিদের ( নেতা) খুনের ছক। গেল বছরের ডিসেম্বরে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) গুলি করে মোহাম্মদ হোসেন (৩০) নামের এক রোহিঙ্গা মাঝিকে হত্যা করা হয়েছিল৷ তখন রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছিলেন , ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি’র (আরসা) ১০-১২ জনের একটি দল তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছে। তবে তাদের সেই অভিযোগ আমলে নেয় নি পুলিশসহ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। ৫ই ফেব্রুয়ারী নুরুল বশর নামের আরেক রোহিঙ্গাকে খুন করা হয়েছে।
রবিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুনে পুড়েছে প্রায় দুই হাজার ঘর৷ দুপুরে লাগা আগুন নেবানোর কাজেও বাঁধা দেয়া হয়েছে ভেরত থেকে। এ বিষয়ে আবদুর রহমান, লফিফুর রহমান নামের দুইজন ক্যাম্পের বিভিন্ন প্রান্তে আগুন দেবার দৃশ্য দেখেছেন। তাদের ভাষ্য মতে , ‘ কয়েকদিন ধরে অপরিচিতদের আনাগোনা বেড়েছে ক্যাম্পকে। উঠতি বয়সী কিছু ছেলে আগুন লাগিয়ে দেয় ক্যাম্পের কয়েকটি ঘরে। আগুন নেবানোর জন্য যাওয়া রোহিঙ্গাদের বাঁধাও দেয়া হয়েছে। আগুন ১০,১১ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ার পর তারা সরে যায় ক্যাম্প থেকে।
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দউল্লাহ বলেন , ৩ টি ক্যাম্পের ৮টি ব্লকের কয়েক হাজার ঘর পুড়ে গেছে। এই ক্যাম্পগুলোর কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে আছে। ‘
ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন দেবার দাবি তার। একই অনুযোগ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি ছমদ আলীর। তার দাবি, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি ড. হাসান উল হায়দার বলেন, সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে প্রতিটি ক্যাম্পে চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। সন্ত্রাসীরা যেন সেখান থেকে বের হতে বা প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য এপিবিএনের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের স্বার্থহানি হলেই অনেকে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে অঘটনগুলো ঘটাচ্ছে। তবে আমরা সবদিক দিয়েই সতর্ক রয়েছি।’
আগুনের সূত্রপাত কীভাবে তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এক যুবককে আটক করেছে এপিবিএন ও পুলিশ। আটক যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের পর কিভাবে আগুন লেগেছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যাবে বলে পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।’
এদিকে, আগুন নেবানোর ব্যস্ততার মাঝেই অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। সুত্রমতে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যস্ততার ফাঁকে অন্যান্য আশ্রয়শিবিরের শত শত রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বাইরে পালিয়ে যান। এদের মধ্যে ২০ জন মরিচ্যা বাজারে র্যাবের হাতে ধরা পড়লেও অনেকে কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন পাহাড়ের বসতিতে আশ্রয় নিয়েছে।