::: নেওয়াজ তুহিন :::
কর্ণফুলী নদীর তীর দখল করে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ, নদী দূষন বন্ধে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নানা উদ্দ্যেগ সফলতা পায় নি। গেল বছরের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম সফরে এসে নদী কমিশনের চেয়ারম্যান সাত দিনের মধ্যে নদী দখল করে গড়ে তোলা ‘কর্ণফুলী শিপ ইয়ার্ড’এর স্থাপনা সরানোর নির্দেশ দিলেও, গত হয়েছে চার মাস সময়। দখলদারদের কব্জা মুক্ত হয় নি কর্ণফুলী নদী।
বরিবার (৫ ই মার্চ) আবারও চট্টগ্রাম সফরে এসেছেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী । বরিবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সাথে বৈঠক করে তিনি কর্ণফুলী নদীর তীর দখল করে নির্মিত বরফকল, মাছ বাজার, বেসরকারি কনটেইনার ডিপো, শিপ ইয়ার্ডের বিভিন্ন স্থাপনা সরানোর বিষয়ে কথা বলেছেন। সোমবার সকালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তীর দখল করে নির্মিত বেসরকারি ইন্টারকনট্রেড ডিপো পরিদর্শন করেছেন। সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে নদীর তীর দখল করে গড়ে তোলা স্থাপনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন। তবে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ শুধু পরিদর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা সেই প্রশ্নের জবাবে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ বলেন, ‘ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জায়গা ইজারা নিয়ে নদীর তীরে এসব স্থাপনা যুগ যুগ ধরে নির্মিত হয়ে এসেছে। হুট করে তো সরানো সম্ভব হবে না। চট্টগ্রাম বন্দর তো কর্ণফুলী নদীর মালিক নয়, তারা কিভাবে নদীর অংশ ইজারা দেয়? সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ইজারা দিতে পারে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসার লাইসেন্স অথোরিটি, ইজারা এই সংস্থাটি কিভাবে দিলো – সেই প্রশ্নের সুরাহ করতে হবে। ‘
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, কর্ণফুলী নদী সারাদেশের সম্পদ। নদী দেখাশোনা করার দায়িত্ব নদী কমিশনের। এখন অবৈধ দখলদাররা বন্দরের ইজারার কাগজ দেখাচ্ছে। নৌ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে এসে নদী দখল করতে পারে কিনা – সেটি বিবেচনায় আনতে হবে । বন্দর কর্তৃপক্ষ কিংবা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে তীর দখল করেছে, স্থাপনা নির্মাণ করেছে ; তাদের অবৈধ কিভাবে বলবো?
গেল বছরের নভেম্বর মাসে কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে ওঠা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘কর্ণফুলী ড্রাইডকের কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। পরে, প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের নথি প্রদর্শন করে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়। এভাবেই নদী কার, নদীর ভূমি কার – এমন টানাহেঁচড়ায় কর্ণফুলী নদীর তীর দখলে নিয়ে নিশ্চিন্তে বহাল রয়েছে অবৈধ দখলদাররা।
এভাবে কর্ণফুলী নদীর দুই পার ক্রমেই দখলে নিয়েছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। নদীর তীর ঘেঁষে নির্মিত কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে দূষণ বেড়ে চলেছে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। কুটকৌশল ব্যবহার করে এখনও নদীর দুই পাড়ে নির্মিত হচ্ছে নিত্য নতুন অবৈধ স্থাপনা। কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট থেকে পতেঙ্গা অংশ গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বরফকল ও শীপ ইয়ার্ড থেকে প্রতিদিনই নদীতে পড়ছে টনে টনে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য। যা নদী ভরাটের পাশাপাশি দূষিত করে তুলছে। কর্ণফুলী নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত।
পরিবেশবাদী সংগঠন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন ২০২২ সালে কর্ণফুলী নদীর গভীরতা ও দখল জরিপ করেছিলো। এরমধ্যে চাকতাই খালের মোহনার উত্তর পাশে নদীতে গভীরতা পাওয়া যায় মাত্র সাড়ে ১৩ ফুট, আর দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা পাওয়া যায় ৪৮ ফুট। একইভাবে রাজাখালী খালের মোহনায় গভীরতা পাওয়া যায় মাত্র ৪ ফুট। মাছ বাজার গড়ে উঠা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় নদীর গভীরতা পাওয়া গেছে সাড়ে সাত ফুট।
এসব স্থাপনা উচ্ছেদে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর নোটিশ প্রদান করা হয়। নোটিশ দেওয়ার তিন বছর দুই মাস অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারণে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যকর ব্যবস্থা নেয় নি জেলা প্রশাসন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করে দায়িত্ব শেষ করেছে জেলা প্রশাসন। একই সময়ে নদীর তীর এলাকায় ছয়টি পাকা দোকানের নির্মাণকাজ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি আমিনুল হক ওরফে বাবুল সরকার । তিনি আবার ফিশারিঘাট পরিচালনা কমিটি সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
পরিবেশবাদী একটি সংগঠনের উদ্দ্যেগে পতেঙ্গায় বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত দুই তীরে পরিচালিত গবেষণার তথ্যে অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত নদীতে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এই অংশে নদীর দুই তীরে উদ্ভিদের সংখ্যা কম। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে দূষণ ও দখলের কারণে হুমকির মুখে থাকা কর্ণফুলীর দুই তীরের ৫২৮টি প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশই বিপন্নের মুখে। নদীর দুই তীরের বিরল ৮১টি প্রজাতির অনেকগুলোই অবৈধ তীর দখল ও নদী দুষণের কারণে সৃস্ট পরিবেশগত বিপর্যয় কারনে ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে বলে সেই গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিলো।
সংশ্লিষ্টদের মতো, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, bwta, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়- বিভিন্ন সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় কর্ণফুলী নদীর দুই তীর বেদখল হয়েছে। তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা কল কারখানার কারণে নদীর মোহনা থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীতে দূষণ সবচেয়ে বেশি এবং এই অংশের দুই তীরে উদ্ভিদের সংখ্যা কম। কিন্তু কালুরঘাট সেতুর পর থেকে কাপ্তাই অংশে দূষণের পরিমাণ যেমন কম এবং উদ্ভিদও রয়েছে বেশি।
চট্টগ্রাম নগরের ব্রিজঘাট এলাকায় ১৯৯০ সালে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার। এই ঘাটের কাছাকাছি চাক্তাই এলাকায় ২০০৬ সালে শুরু হয় শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর নির্মাণকাজ। ৯৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে বস্তি, পাকা অবকাঠামোসহ নানা স্থাপনা গড়ে ওঠে। তারও ছয় বছর আগে নদীর জায়গা ইজারা দেওয়া হয় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র তৈরির জন্য। ফলে সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ কমে হয়েছে প্রায় ৫১০ মিটার।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠনের জরিপ অনুযায়ী সেতু এলাকায় জোয়ারের সময় নদীটির প্রস্থ ৫১০ মিটার আর ভাটার সময় ৪১০ মিটার। ২০১৪ সালে এডিবির পরিমাপ অনুযায়ী, সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে প্রস্থ ছিল ৮৯৮ মিটার, পরে কমে হয়েছে ৪৩৬ মিটার।