::: আফরিন আফসার :::
গুজরাটের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করেছে বিবিসি। সেই প্রামাণ্যচিত্র ভারতে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এমনকি সেই প্রামাণ্যচিত্র তৈরির জের ধরে ভারতে বিবিসি কার্যালয়ে দেশটির আয়কর বিভাগের নজিরবিহীন তল্লাশি সারা বিশ্বে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ শিরোনামের একটি বিবিসি ডকুমেন্টারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘ভারতের গুজরাট রাজ্যে ২০০২ সালের মুসলমানদের গণহত্যার জন্য সরাসরি দায়ী’ বলে অভিযুক্ত করেছে।মোদি পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দাঙ্গায় ১ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল – যাদের বেশিরভাগই মুসলমান। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি ট্রেনে আগুন লাগার পর সহিংসতা শুরু হয়, এতে ৫৯ জন নিহত হয়। এর ফলে শত শত মুসলমান বাস্তুচ্যুত হয় এবং শত শত মসজিদ ধ্বংস হয়, তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে। বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র দীর্ঘ ২১ বছর আগের নারকীয়তা ও নির্মমতার কাহিনি আবারও সামনে এনেছে বিশ্ববাসীর।
গুজরাটে ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধড়ায় একটি ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে কারণে অযোধ্যা থেকে ফিরে আসা ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী মারা যায়। সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুন লাগানোর ঘটনার প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছিল হিন্দুত্ববাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল৷এই ঘটনাকে গুজরাত সহিংসতার প্ররোচনা বলে উল্লেখ করা হয়। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, সেবারের দাঙ্গায় ১,০৪৪ জন নিহত হয়েছেন , ২২৩ নিখোঁজ এবং ২,৫০০ আহত হয়েছিলেন। একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে স্থানীয় মুসলিমরাই নাকি সেই ট্রেনে আগুন লাগাবার জন্য দায়ী। আর স্রেফ সেই গুজবের উপর ভিত্তি করে গুজরাটে রচিত হয় ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় ‘গুজরাট দাঙ্গা’ (The Gujrat Riot).

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মসনদকে নড়বড়ে করে দেওয়া বিবিসির প্রামাণ্যচিত্রে গুজরাটের দাঙ্গায় সংগঠিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পুরোপুরি উঠে আসেনি। ‘মুসলিমরা আগুন লাগিয়েছে’ সেই গুজবের ছড়িয়ে পড়ার পর শত সহস্র হিন্দুরা মুসলিমদের ঘরে আক্রমণ চালায়, মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করে, আগুনে পুড়িয়ে মারতে শুরু করে মুসলমানদের । প্রায় সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হয় এই রক্তপাত। প্রায় ২০০০ এর মতো মুসলিমকে মাত্র কয়েকদিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, আহত হয় আরও অনেক। যদিও সরকারীভাবে দেখানো হয় মাত্র ১০৪০ জন মুসলিম মারা যাবার কথা !
সেসময় মুসলিম মায়ের পেট চিরে ৯ মাসের ভ্রুণকে বের করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলো হিন্দুরা।২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় নারোদা পাতিয়া গণহত্যায় (আহমেদাবাদ এলাকায়) সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলো ‘বাবুভাই প্যাটেল ‘ নামের এক হিন্দু উগ্রবাদী নেতা। সেই বাবু ভাই প্যাটেল সারা বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়েছিলো ‘বাবু বজরঙ্গি’ হিসেবে। বাবু বজরঙ্গি কিভাবে গুজরাটে মুসলিম মেরেছিলো সেই কথা জানার জন্য ২০০৭ সালে তেহেলকার ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক হাজির হয়েছিলো বাবু বজরঙ্গির কাছে।
সেই সাংবাদিককে বাবু বজরঙ্গি খুব গর্বের সাথে সেই গণহত্যার নির্মম বর্ণনা দেয়, কিন্তু সেই বর্ণনা শরীরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা গোপন ক্যামেরায় গোপনে ভিডিও করে ফেলে ঐ সাংবাদিক। সেখানে ‘বাবু বজরঙ্গী’ নিজ মুখেই গর্বের সাথে স্বীকার করেছিলেন , কিভাবে এক মুসলিম মায়ের পেট চিরে ৯ মাসের ভ্রুণকে বের করে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন।
বাবু বজরঙ্গীর নিজ মুখেই সেই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে,
“…..কেটে টুকরা করা, পুড়িয়ে দেয়া, আগুন ধরানো অনেক কিছুই করা হল, অনেক কিছুই। আসলে আমরা মুসলমানদের আগুনে পুড়াতেই বেশি পছন্দ করি, কারণ এই জারজরা তাদের দেহ মৃত্যুর পর চিতায় পুড়াতে চায় না। আমার শুধু একটি ইচ্ছা, শুধু একটি শেষ ইচ্ছা , আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হোক । আমাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হলেও তা গ্রাহ্য করব না ।তবে আমাকে ফাঁসিতে দেওয়ার আগে মাত্র দুইদিন সময় দেয়া হোক, আমি জুহাপুরা (মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা) চলে যাব। সেখানে ৭-৮ লক্ষ লোক বাস করে। আমি তাদের শেষ করব কম করে হলেও তো সেখানে আমার ২৫-৫০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা উচিত।
গুজরাটের সেই গণহত্যার পর থানায় করা মামলার নথিতে লেখা হয়, এক গর্ভবতী মুসলিম মহিলার পেট চিরে আমি ৯ মাসের ভ্রুনকে বের করেছি, নিক্ষেপ করেছি আগুনে। আসলে আমি তাদেরকে দেখিয়েছি- দেখ ! আমাদের বিরোধীতার শাস্তি কি। একজনকেও ছাড়া যাবে না। এমনি তোদের ভূমিষ্ট হতেও দেয়া যাবে না। আমি বলেছি, যদি মহিলাও হয় , যদি শিশু হয় তবু তাদের কেটে ফেল , চিঁড়ে ফেল , টুকরো করে ফেল , আগুনে পুড়াও সকল মুসলমানদের। আমাদের অনেকে তাদের ঘরবাড়ি লুট করতে অযথা সময় নষ্ট করছিল। আমি বলেছি অযথা এ কাজ না করে তাদের কাউকে বাঁচতে দিও না, এরপর সবই তো আমাদের। আমরা দল বেঁধে বেঁধে মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঘুরছিলাম। প্রত্যেকেই মুসলমান মারছিল অতি উন্মাদনার সাথে।
নরেন্দ্র মোদি ? মূখ্যমন্ত্রী ‘নরেন্দ্র মোদি’ আমাকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য তিন তিন বার বিচারককে পরিবর্তন করে দেয়। মুসলমান মারতে এত্ত মজা লাগে না । সাহেব, আসলে তাদের মারার পর আমার নিজেকে রানা প্রতাপ বা মহেন্দ্র প্রতাপের মত (মুসলিম নিধনকারী রাজা) মত মনে হয়েছে। এতদিন শুধু তাদের নাম শুনেছি, কিন্তু সেই দিন আমি তাই করলাম । যা তারা আমার জন্য করেছিল।
নরেন্দ্র মোদি সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। নিজেই দাঙ্গায় প্ররোচিত করেছেন। নিজেই অপরাধীদের মুক্ত করেছেন। সেই ভয়াবহ দাঙ্গা থেকে জীবন বাঁচিয়ে কোনভাবে বৃটেন ফেরত যান কয়েকজন বৃটিশ ইন্ডিয়ান। তাদের মুখে দাঙ্গার ভয়াবহতার কথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেসময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্থানীয় হিন্দুদেরকে সরকারি পুলিশ বাহিনী দিয়ে দাঙ্গায় সাহায্য করেছিলেন । গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচনে মোদির অন্যতম প্রতিপক্ষ এহসান জাফরির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল বেশ কিছু মুসলিম। কিন্তু প্রায় বিশ হাজার উন্মত্ত হিন্দু তার বাড়ি ঘেরাও করে। হিন্দুদের বিক্ষোভের মুখে শেষমেশ ‘এহসান জাফরি’ নেমে এলে তার হাত ও পা দু’টো কেটে মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়ায় উগ্রবাদী হিন্দুরা। শেষে এহসান জাফরির মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এহসান জাফরীর ভাইয়ের ছেলে সেই ঘটনার বর্ণনা দেন পরে। বর্ণনা মতে, তাদের ঘরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় মুসলিম পুরুষদের নির্মমভাবে কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়; নারীদের ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছিলো। ঘটনার ভয়ানক রূপে আতঙ্কিত ৯৮ হাজার মুসলিম গুজরাট থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। এক রাতের ব্যবধানেই এতো অধিক সংখ্যক মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। কোনো কোনো হিসেব মতে সেই সংখ্যা আসলে দেড় লক্ষেরও অধিক।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে এসেছিল আরও বেশ কয়েকটি গণহত্যার কথা। এদের মধ্যে অন্যতম ‘গুলবার্গ ম্যাসাকারে’ একসাথে ৯০ জন মুসলিমকে হত্যার ঘটনা।
যদিও প্রথমদিকে মনে করা হতো, নরেন্দ্র মোদি কোন ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ করে ছিল বলেই উন্মাদ হিন্দুরা এই গণহত্যার সুযোগ পায়। কিন্তু গুজরাটের সিনিয়র ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা সঞ্জিব ভাট পরবর্তীতে আদালতের জবানবন্দিতে জানিয়ে দেয় এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ‘গোপন সত্য’। সেই সময় দায়িত্বে থাকা সন্জিব ভাটের নানারকম স্পর্শকাতর তথ্য জানা ছিল। আদালতে সে জানায়,
“দাঙ্গা শুরু হবার আগের রাতে মোদি অফিসিয়ালদের নিয়ে এক মিটিংয়ে বসেছিল। সেই মিটিংয়ে মোদি সবার উদ্দেশ্যে বলেছিল যে তীর্থযাত্রীদের হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ মুসলিমদের এক উচিত শিক্ষা দিতে হবে।” আর দাঙ্গা শেষ হবার পর মোদিকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলেছিল গুজরাটের ব্যাপারে তার কোনোই অপরাধবোধ নেই। এসমস্ত কারণে নরেন্দ্র মোদিকে এখনও ডাকা হয় ‘গুজরাটের কসাই’ নামে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল তার লেখা একটি বইয়ে অভিযোগ করেছেন, গুজরাট দাঙ্গার সময় প্রশাসন সেনা নামাতে চব্বিশ ঘন্টারও বেশি দেরি করেছিল – যেটা না-হলে হয়তো বহু প্রাণহানি ঠেকানো যেত।সেনাবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান জমিরউদ্দিন শাহ গুজরাট দাঙ্গার মোকাবিলায় মোতায়েন করা সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন, তিনি তার বইতে দাঙ্গা ঠেকানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছিলেন।
‘দ্য সরকারি মুসলমান’ নামে তার ওই বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে ভারতের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিও দাঙ্গার সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।এছাড়া ভারতের চরম হিন্দুত্ববাদী সংস্থা RSS এর একজন সদস্য হিসেবে আর চরম হিন্দুত্ববাদী নেতা যোগি আদিত্যনাথের সাথে দীর্ঘকালের সুসম্পর্ক মোদির উগ্রবাদী আদর্শ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
দীর্ঘ দশ বছর পরে ২০১২ সালে ৩১ শে আগস্ট গুজরাটের সেই দাঙ্গায় জড়িতদের বিষয়ে আদালত একটি রায় দেয়৷গুজরাটে, গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গায় দোষী সাব্যস্ত ৩১ জনের শাস্তি ঘোষণা করে আহমেদাবাদের এক বিশেষ আদালত৷ মূল অপরাধী হিন্দুত্ববাদী বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গিকে দেয়া হয় আজীবন কারাবাস এবং মোদি সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং নারোদা-পাটিয়া এলাকার বর্তমান বিজেপি বিধায়ক মায়া কোডনানিকে দেয়া হয়, ভারতীয় দণ্ডবিধির এক ধারায় ১০ বছর এবং অন্য ধারায় ১৮ বছর মোট ২৮ বছর কারাবাসের আদেশ৷ অবশিষ্টদের দেয়া হয় ১৪ বছর থেকে ২১ বছর কারাদণ্ড দেয় আদালত৷ এছাড়া আদালত গণধর্ষণের শিকার এক মহিলাকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলে মোদি সরকারকে৷ যদিও ধর্ষণের ঘটনায় আসামিরা মৃত্যুদণ্ড পাবার যোগ্য ছিলো।
আহমেদাবাদের নিম্নবিত্ত সংখ্যালঘু এলাকা নারোদা-পাটিয়ায় বন্ধ-সমর্থকরা দাহ্য পদার্থ এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানোর ঘটনায় করা হয়েছিল মামলাটি ৷ সেই দাঙ্গায় মারা যায় ৯৭ জন৷ তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী ও শিশু৷ তবে ভারতের আহমেদাবাদের বিশেষ আদালতের রায়ে ৩২ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন বিচার চলাকালীন মারা যায়, ২৯জন বেকসুর খালাস দেয় আদালত।
কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং সেসময় বলেছিলেন, গুজরাট দাঙ্গায় বিজেপির নেতা-কর্মীরা যে জড়িত ছিলেন, সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল৷ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন কোন মন্তব্য করেননি৷ তবে ২১ বছর পরে বিবিসির প্রামাণ্যচিত্রে ‘মোদির গোপন রাজকথন ফাঁস হলো৷