::: ওয়াহিদ জামান :::
সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা আর সমাজের পরিবর্তনের সাথে আবেগময় সম্পর্ক রয়েছে। একটি রাষ্ট্রে সুশাসন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ গতিশীল হয়ে উঠছে সেটি নির্ভর করে সেই দেশে কিভাবে সংবাদ তৈরি এবং কিভাবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। সাংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতার ক্লাসিক ধারণাটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই , প্রকৃতপক্ষে, বস্তুনিষ্ঠতা সংবাদের ধারণাটিকেই নতুন আকার দিচ্ছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তথ্য, ডেটা এবং সোশ্যাল মিডিয়া আরও সর্বব্যাপী, আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠলে সাংবাদিকতার আমাদের জীবনে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তৈরি করবে ।
এই মুহুর্তে যেটিকে সাংবাদিকরা একটি পেশাদার ঘটনা হিসাবে অন্বেষণ করছেন সেই মুহুর্তে হয়তো নাগরিকরা এটিকে ব্যক্তিগত কিছু হিসাবে দেখছেন। সেজন্য গণমাধ্যমে পেশাদারিত্বের বিষয়টি আরও ভালভাবে বোঝার জন্য সাংবাদিক হিসেবে আমাদের আবেগ, সংবাদের সাথে বোঝাপড়া এবং আচরণের মধ্যে সম্পর্কের চারপাশের মনস্তাত্ত্বিক জগতকে অনুধাবন করার ছাড়া কোন উপায় নেই ।
বিভিন্নসময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সাংবাদিকতা, যখন টিভির মাইক্রোফোন দূর্ঘটনার শিকার মৃত্যু পথযাত্রীর কস্টের অনুভূতি জানতে চাচ্ছে। একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ফাঁস করে, যখন সংবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের অতি ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণকে বাধাগ্রস্ত করেছে৷ কিন্তু গণমাধ্যম যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হচ্ছে – তখন সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার ক্লাসিক ধারণাটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতেই হচ্ছে।
একটি সভ্য সমাজে সুষ্ঠুভাবে কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন মুক্ত ও বৈচিত্র্যময় সংবাদ মাধ্যম, যা জনগণকে তার মৌলিক অধিকার, সমাজ রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবগত রাখতে সক্ষম৷ জনগণের বিষয়ে জনগণ বা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাকে নিয়ে, অধিকার নিয়ে – আলোচনাকে সক্ষম করে।
গবেষণা অনুযায়ী ‘মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা’ জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞান, অংশগ্রহণ এবং ব্যস্ততার মাত্রা বাড়াতে পারে। এবং উপরন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এবং জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আরও কার্যকরভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে উৎসাহিত করতে পারে। যদিও গণতন্ত্রকে সক্ষম ও সক্রিয় করতে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, বৈচিত্র্য এবং ক্ষমতা ; পৃথক পৃথক দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে। ডিজিটাল মিডিয়ার উত্থানের সাথে যুক্ত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং মুক্তবাজারের উন্নয়নের ফলে এই গণমাধ্যমের পরিবেশ আংশিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
একটি কার্যকর গণতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে প্রাসঙ্গিক তথ্য বা বিষয়গুলির সঠিক তথ্যের অবারিত সুযোগ গণমাধ্যমকে পরিপুষ্ট করে তোলে। সাধারণ মানুষ সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভর করে, যদি গণমাধ্যমের ভূমিকা তাদের রাজনৈতিক এবং সমষ্টিগত বিষয়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হয়, নিরপেক্ষ হয়৷
যদি গণমাধ্যম কোন ইস্যুতে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাসঙ্গিক এবং বহুমুখী বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে – তবেই সাধারণ মানুষের কাছে মুক্ত গণমাধ্যমের কল্যাণকর প্রভাব পড়বে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব, তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের সুযোগ অবারিত না হলে অপেশাদার গণমাধ্যম তৈরি হবে না৷ গণমাধ্যম নিরেপক্ষভাবে তথ্য প্রকাশ করতে না পারার কারণে বর্তমানে আমাদের দেশে গণমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অধিক জনপ্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে। কোন ইস্যুতে গুজব ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রকৃত সাংবাদিকরা শুধুমাত্র ডিজিটাল পরিবেশে যে এক্সপোজার নিয়ে আসে তা থেকে সমাজ ও জনগণ উপকৃত হয় না, একই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নখদর্পণে খুটিনাটি, সীমাহীন তথ্যও পাওয়া যায়।তদুপরি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো অসংখ্য প্ল্যাটফর্মে লক্ষ লক্ষ কথোপকথন হচ্ছে, যার অর্থ এই ক্ষেত্রে যারা কাজ করছে তাদের লুপে থাকার জন্য অনলাইন হতে হবে। একারনে ইন্টারনেট এবং ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া টনকে টন জাল খবর এবং ভুল তথ্য দিয়ে দূষিত করছে গণমাধ্যম । যেহেতু ডিজিটাল শূন্যতার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত কিছুর সত্য-পরীক্ষা করা যায় না, তাই সত্যগুলিকে মিথ্যা থেকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাংবাদিকতার উৎকর্ষতাকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল এনে দিয়েছে ।
সোশ্যাল মিডিয়া- বর্তমানে যা ঘটছে তার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম। এটি এতটাই জনপ্রিয় যে, সাংবাদিকদের পক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে থাকা, বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী মঞ্চে থাকা অসম্ভব বলে মনে হয়। কোনো ঘটনা ঘটার পর সেকেন্ডে প্রকাশিত হবার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন সংবাদ দ্রুত বিস্তৃতি পাচ্ছে। প্রতি সেকেন্ডে ছয় হাজারটি টুইট পাঠানো হচ্ছে, সেখানে পেশাদার সাংবাদিকরাও কোন মাইক্রো সেকেন্ডের কথোপকথন মিস করার সামর্থ্য রাখে না।
এক কথায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চিরতরে সাংবাদিকতার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। আমরা সকলেই ‘ভুয়া খবর’ সম্পর্কে শুনেছি এবং আপনি যুক্তি দিতে পারেন যে সোশ্যাল মিডিয়া কিছুটা দায়ী। এটি লোকেদের আক্ষরিক অর্থে কিছু বলার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দেয় , কোনও বিষয়ের বৈধতা বা সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। এখানে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা।
তদুপরি সোশ্যাল মিডিয়া অনেক ভালো কিছুর জন্যও দায়ী। সামাজিক যোগাযোগ পেশাদার সাংবাদিকদের সারা বিশ্ব থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্যে অ্যাক্সেস দিচ্ছে, যখন গনমাধ্যমের জন্য তথ্য অবারিত নয়। যখন রাষ্ট্র মুক্ত গণমাধ্যমের পরিবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, তথ্য গোপন করছে – তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভরসা করা ছাড়া উপায় কি? একথাও সত্য পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য তাদের নখদর্পণে থাকা সংবাদ যেকোন সময় ( দিনের ২৪ ঘন্টা ) সাধারণ মানুষের কাছে পোঁছে দেবার একটি স্বপ্নের প্ল্যাটফর্ম ‘ ‘ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘