:::নাদিরা শিমু :::
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, নিজেকে কর্মবীর দাবি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এযাবত কালে সবচেয়ে বেশি মেয়াদে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবদুচ ছালাম চট্টগ্রামের উন্নয়নের চেয়ে নিজের ইচ্ছা, স্বার্থ, স্তুতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
প্রয়াত সাংসদ আবদুল ওহাবকে ২০১৪ সালে দেয়া প্লট বাতিল করিয়েছিলেন আবদুচ ছালাম। জানা যায় ২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আবদুল ওহাবকে ৪ কাঠা জমির একটি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। সিডিএ’র ৩৯৬ তম সভায় সেই প্লট বরাদ্দের অনুমোদন দেওয়া হয়।প্লটের বরাদ্দপত্র পাওয়ার পর কয়েক দফায় সিডিএ’র অনুকূলে আবদুল ওহাব ১১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা জমা দেন। এরপর তিনি মারা যান। পরে তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা ওই প্লট বরাদ্দ পাওয়ার জন্য ২০১৩ সালের ২২ মার্চ সিডিএ চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন।আবেদন করার পর সিডিএ ২০১৪ সালের ৩ জুন প্লট বরাদ্দের বিষয়ে একটি চিঠি দেয় আবদুল ওহাবের পরিবারের কাছে। ওই চিঠিতে সিডিএ’র পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারি নীতিমালার পরিপন্থি ২৭টি প্লট বরাদ্দ দেওয়ায় সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। যার মধ্যে এম আবদুল ওহাবের প্লটও রয়েছে। পরবর্তী সময়ে অন্যদের প্লট ফিরিয়ে দিলেও এম এ ওহাবের প্লট ফিরিয়ে না দিয়ে প্রয়াত সংসদ সদস্য আবদুল ওহাবের পরিবারকে বিমুখ করেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
নিজ মেয়াদের শেষ সময়ে ১০ কোটি টাকা মূল্যের প্লট তার পাঁচ অনুগতের হাতে তুলে দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন আবদুচ ছালাম। সিডিএর চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে সিডিএর কল্পলোক ও অনন্যা আবাসিক এলাকার পাঁচটি প্লট বরাদ্দ দিয়েছিলেন আবদুচ ছালাম। এরআগেও সাংসদ, মন্ত্রীদের প্লট বরাদ্দে অনিয়মে জড়ায় সিডিএ।
নথি অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর সিডিএ’র ৪০৫তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনন্যা আবাসিক এলাকায় ৬০ জনকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২১ নভেম্বর সিডিএ থেকে বরাদ্দপত্র পাঠানো হয়েছিল। ২৬ ডিসেম্বর বোর্ড সভায় আবাসিক এলাকার সংশোধিত লে আউট অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতি কাঠায় দাম রাখা হয় ৬ লাখ টাকা। এর অনেক আগের প্রকল্প নগরী থেকে দূরে সলিমপুর আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল কাঠা প্রতি ১০ লাখ টাকায়। লে আউট অনুমোদনের আগে প্লট বরাদ্দ দেবার ঘটনা নজিরবিহীন হলে, সেই উদাহরণ সৃস্টি করেছিলেন আবদচ ছালাম। এরআগে দুইযুগ আগে ১৯৮৫-৯০ সালে সলিমপুর আবাসিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সেই প্রকল্পে মোট প্লটের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৯টি।
নিয়ম না মেনে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও এমপিসহ প্রভাবশালীদের প্লট বরাদ্দ দিয়েছিলো চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। অনিয়মের মাধ্যমে সিডিএ’র ইতিহাসে নজিরবিহীন এমন প্লট বরাদ্দের কোন ধরনের বিজ্ঞপ্তি এবং লটারি করা হয় নি। এই প্রকল্পে ছয় লাখ টাকা করে প্রতি কাটা প্লট বরাদ্দ দিয়ে উদাহরণ সৃস্টি করেন প্রাক্তন চেয়ারম্যান। নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষেও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কাউকে প্লট বরাদ্দের সুযোগ নেই। পত্রিকায় আবেদন আহ্বানের পর সংরক্ষিত কোটায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে প্লট বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। ’
সিডিএ’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের অনিয়মে পল্ট বরাদ্দপ্রাপ্তরা হলেন বরাদ্দপত্র পাওয়া মন্ত্রীরা হলেন- জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ( বর্তমানে প্রয়াত), জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তৎকালীন সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার।
চট্টগ্রাম শহরে বাড়ি, একাধিক প্লট থাকার পরও যাদের প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো তারা হলেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জাসদের কার্যকরী সভাপতি মঈন উদ্দিন খান বাদল ( বর্তমানে প্রয়াত) এবিএম আবুল কাশেম মাস্টার ( বর্তমানে প্রয়াত) নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, আবদুল লতিফ, শামসুল হক, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, চেমন আরা তৈয়ব।
সুত্রমতে, আবদুচ ছালাম তার শেষ মেয়াদে প্লট বরাদ্দ দিয়েছিলেন নিজের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সিডিএর দুই বোর্ড সদস্য কেবিএম শাহজাহান ও জসিম উদ্দিন শাহকে। এছাড়া আবদুচ ছালামের নিজস্ব ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) তারেক গণির মা জাকিয়া বেগম, নিজ পারিবারিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ওয়েল গ্রুপের কর্মকর্তা সেতু বড়ুয়া ও হামিদ উল্লাহ নামের আরেক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে তিনটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে কেবিএম শাহজাহানকে অনন্যা আবাসিক এলাকায় এবং অন্যদের কল্পলোক আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে সিডিএ বোর্ড সদস্য ( প্রাক্তন) জসিম উদ্দীন শাহ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে আলাদা বিষয়। মন্ত্রণালয় যাদের অনুমোদন দিয়েছে, তারাই প্লট পেয়েছেন, সিডিএ প্লট দেয়নি। সিডিএ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আমি প্লট দেইনি, প্লট দিয়েছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে প্লট দেয়া হয়েছিল। ‘
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা প্লট ইস্যুতে একইসুরে কথা বলেছেন। তারা জানান , নিজ ধারাবাহিকতায় সিডিএ’র কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য ১১০টি প্লটের মধ্যে ৪০টি প্লট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাদ্দ দেন। সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যানের ইচ্ছামতো কিছু প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল এবং নিজের পছন্দমতো অন্যান্য প্লটগুলো ঘনিষ্ঠদের বরাদ্দ দিয়েছিলেন আবদুচ সালাম।
শুধু প্লট কেলেঙ্কারি নয়, লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেবার বিষয়ে অভিযোগ উঠে সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির কাজ পেতে ১০টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র সংগ্রহ করলেও সর্বনিম্ম দরদাতা হিসেবে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় কাজটি পায় ম্যাক্স র্যাংকিন জেভি। প্রতিষ্ঠানটি এর আগেও সিডিএ’র একাধিক প্রকল্পের কাজ পেয়েছিলো। সেসময় সিডিএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের বিরুদ্ধে ম্যাক্সকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন আনার অভিযোগ উঠে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবদুচ ছালাম সিডিএ চেয়ারম্যানের পদে বসেন।এরপর তার সঙ্গে চট্টগ্রামের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতবিরোধ ঘটে নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে শেখ হাসিনার কাছে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, যেনতেন প্রকারে ফ্লাইওভারের নামে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান স্বঘোষিত ‘কর্মবীর’ আবদুচ ছালামের ইচ্ছেমাফিক উন্নয়ন নামের জঞ্জালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এখনো তার খেসারত দিচ্ছে চট্টগ্রামবাসী।
এছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে নগরীর কাজির দেউড়ি বাজারের সাবস্টেশনের বদলে নিজের মালিকানাধীন ওয়েলফুডের শো-রুম বসানোর খবরও পুরোনো। ২০১৭ সালে পুরানো বাজার সরিয়ে কাজির দেউড়ি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স ও কাঁচাবাজার নির্মাণ করে সিডিএ। কমপ্লেক্সটি নির্মাণের পর আবদুচ ছালাম ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকে অভিযোগপত্র জমা দেন কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজারের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। টাকার বিনিময়ে এলোমেলো দোকান বরাদ্দ ও কাঁচাবাজারের সাবস্টেশনের জায়গায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে ওয়েলফুডের শো-রুম স্থাপনসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়।