:::আল আমিন,নাটোর প্রতিনিধি:::
‘মানুষ মানুষের জন্য- জীবন জীবনের জন্য’ মানব জনমকে সার্থক করতে অনেকেই এই অমর বাণীকে কাজে লাগিয়েছেন। তাদের ‘ই’একজন পলান সরকার।
গ্রামের মেঠো পথে ঘুরে নিজের টাকায় কেনা বই পাঠকের বাড়ি পৌঁছে দিতেন পলান সরকার। মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রায় ৩০ বছর তিনি এই সংগ্রাম চালিয়ে যান। বইপড়া বিষয়ে ব্যতিক্রমী এক আন্দোলন গড়ে তোলার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১১ সালে পলান সরকারকে একুশে পদকে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
দেশব্যাপী পলান সরকার নামে পরিচিতি লাভ করা একুশে পদকজয়ী এ ব্যক্তির আসল নাম হারেজ উদ্দিন। তিনি ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তার বাবা মারা যান। আর্থিক টানাপড়েনে ষষ্ঠ শ্রেণিতেই পড়াশোনার ইতি পড়ে তার।
১৯৯২ সালে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে নিয়ম করে হাঁটা শুরু করেন তিনি। তার সঙ্গেই তিনি যোগ করে নেন বই বিলি করার বিষয়টি। প্রতিদিন সকালে পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাড়ি বাড়ি নতুন বই দেওয়া আর পুরনো বই ফেরত নেওয়া শুরু করেন তিনি। শুরুতে তার এই আন্দোলনের কথা রাজশাহীর কয়েকটি গ্রামের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০০৬ সালে বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে পলান সরকারের নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। রাজশাহী জেলা পরিষদ ২০০৯ সালে তার বাড়ির উঠোনে একটি পাঠাগার করে দেয়। ২০১১ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
কয়েক বছর আগে বই বিতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন পলান সরকার। স্থানীয় বাজারে কয়েকটি দোকানে মালামালের পাশাপাশি বই রাখার ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকেই স্থানীয়রা বই নিয়ে যায় পড়ার জন্য। বই পড়া শেষে নিজেরাই আবার বই ফেরত দিয়ে যায়। পলান সরকার ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যতদিন হাঁটতে পারবেন, সমাজ বদলের এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান তিনি। ২০১৯ সালের ১ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নিজের টাকায় বই কিনে পলান সরকার পড়তে দিতেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেক দিন একেক গ্রামে যেতেন। আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দিতেন গ্রামবাসীদের। উপাধি পেয়ে যান ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ নামে।
বইয়ের প্রতি তার এ ভালোবাসার জন্য দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে তাকে নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর আগে তার মহৎকর্ম প্রচারিত হয় জনপ্রিয় টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’সহ বিভিন্ন মাধ্যমে। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি নাটক। নাটকটির নাম ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’।
মহান এই মানুষটির আজ পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। পলান সরকার হাজার বছর বেঁচে থাকবেন এদেশের বই প্রেমী কোটি পাঠকের হৃদয়ে।