:::রাহাত আহমেদ :::
দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির অনড় অবস্থান এবং ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগের সংবিধানের অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন- মাঝামাঝি ‘সমাধান’ খুঁজতে তৎপরতা বেড়েছে কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহলের। বহি:বিশ্বে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো৷ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সমঝোতার ইস্যুতে মাঠেও নামানো হয়েছে৷ সুত্রমতে, বিএনপিসহ সরকার বিরোধী ৫৪ টি দলের সাথে পর্দার আড়ালে আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল সাম্প্রতিক সময়ে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে। তিনি বলেন, “আশা করি আগামী কয়েক মাসে হয়ত দেখব একটা রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে এবং সব দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। আমাদের বিভিন্ন দল থেকে বলা হয়েছে, তারাও বিশ্বাস করবেন যে একটি সমাঝোতা হবে।”
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি ইস্যুতে নমনীয়তা প্রদর্শন এবং ভোটে ইভিএম থেকে আসার বিষয়গুলো পর্দার আড়ালে সমঝোতা ফল হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে, বিএনপি আপাতত মাঠে থাকতে চায় পদযাত্রা, সভা সমাবেশের মধ্যে দিয়ে। আর আওয়ামীলীগের নীতিনির্ধারকরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি। সামনের জাতীয় নির্বাচন গেল দুইবারের নির্বাচন থেকে ভিন্ন হবে ও গ্রহনযোগ্য কিছু হবে – এমন ভাবনাকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলছে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দুজনের সাথে কথা বলে সমঝোতার আভাস মিলেছে। ঠিক তেমনিভাবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারনী পর্যায় থেকে বিরোধী দলগুলোর সাথে নির্বাচন ইস্যুতে আলাপ আলোচনা চালিয়ে রাখার কৌশল নেয়া হয়েছে। তত্ববধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না – সেটিই নিশ্চিত বলছেন দলটির নেতারা৷ আবার আওয়ামী লীগও এই বিষয়ে ছাড় দিতে নারাজ। সেকারণে ‘মাঝামাঝি কিছু’ সমাধানের খোঁজে সরকারের সাথে দূতাবাসগুলোর তরফ থেকে আলোচনা চলছে। একইসাথে পর্দা আড়ালেই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সুবিধাজনক সমাধান খুঁজছে সরকার।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা পদযাত্রার মতো কর্মসূচিতে সময় ক্ষেপন করতে চায় জুন পর্যন্ত। এরপরই পুরোদমে রাজপথে সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করবে দলটি৷ দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও পদযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণকে ‘ইতিবাচক ‘ হিসেবে দেখছে দলটির নেতারা। আর আওয়ামী লীগও সমাবেশ পদযাত্রাকে কিছুটা ছাড় দিয়ে বিএনপির মনোভাবে নমনীয়তা ফেরাতে চান।
বিএনপির আন্দোলনের বিপরীতে সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ । এছাড়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের যে নজিরবিহীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সেগুলোও আমরা তুলে ধরে ভোটে মাঠে ইতিবাচক প্রচারণা চালাতো চায় তারা। দলটির নেতারা বলছেন, যারা দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা কীভাবে মানবতাকে ভূলুষ্ঠিত করেছে এবং বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিকে কীভাবে নষ্ট করেছে, সেগুলো সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতে মাঠে থাকার নির্দেশনা রয়েছে দলীয় প্রধানের৷ আওয়ামী লীগ নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি, সংহতি বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, ধ্বংসের রাজনীতি জনগণের সামনে তুলে ধরবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, ‘দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে যে হতাশার জন্ম নিয়েছিল, বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসমাবেশ, পদযাত্রা করে তা অনেকটা কেটে গেছে।সরকারবিরোধী আন্দোলনে কর্মীরা ত্যাগ স্বীকারে কিছুটা বেপরোয়াও হয়ে উঠেছে, যা ঢাকার সমাবেশের আগে পল্টনে দলের অফিসের সম্মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ জাতীয় নির্বাচনে ভোটের জন্য এমন একটি পদ্ধতি বেছে নিতে হবে যার সঙ্গে মানুষ পরিচিত, যার প্রতি আস্থা আছে এবং যার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ নয়। ‘
বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে যখন দরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণকে আস্থায় নেয়ার প্রক্রিয়া করা হচ্ছে তখন সরকার ও বিএনপির এক শ্রেণীর নেতারা রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা আরও বাড়িয়ে তুলছে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক উত্তেজনা নিরসনে সমঝোতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে তাদের রাজনীতিও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। বলা হচ্ছে, জুন মাসের পরে ভোটের লড়াইয়েই ছাড়িয়ে যেতে পারে রাজনীতির উত্তাপ। সমঝোতার বদলে সরকারের আচরণ বাড়িয়েও দিতে পারে সেই উত্তাপ ; এমন বিশ্লেষণও করছেন বিশ্লেষকরা।
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ টেকসই হবে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) কিংবা অন্যান্য উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এসডিজি অনুযায়ী গণতন্ত্র উন্নয়নের অংশ। আবার মানবাধিকারও উন্নয়নের অংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও সই করেছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক শক্তি সমঝোতায় না এলে সামাজিক শক্তি এগিয়ে আসে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন কিংবা ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন এর বড় উদাহরণ।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখন যদি সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না যায় তাহলে বড় আকারে জাতীয় ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। একজন বিএনপি কর্মী হেলমেট পরে যেভাবে পুলিশের সঙ্গে লাঠি নিয়ে লড়াই করেছে তাতে বিএনপির কর্মীদের আক্রমণাত্মক ও বেপরোয়া মনে হয়েছে। ‘
বিশ্লেষকদের মতে, ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই বাংলাদেশ এক ধরনের নামমাত্র গণতন্ত্রের সাথে পরিচিতি লাভ করেছে ; তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। উদার গণতান্ত্রিক দেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো স্পষ্ট হয়। কিন্তু গেল চৌদ্দ বছরের রাজনীতিতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এ মাত্রাগুলো সবসময় ভোটাধিকার চর্চায় ফোকাস হয় নি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরাতে পারে সামনের জাতীয় নির্বাচনকে।