:::রাহাত আহমেদ :::
বাবলা দাস গুপ্ত, সমবায় অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী। পদে তিনি যতোটা ছোট তার দূর্নীতির জাল ততটাই বিস্তৃত। নিয়োগ বাণিজ্যে শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন বাবলা দাশ গুপ্ত। মা সাধনা দাশ গুপ্তও তার ক্ষমতার খুঁটি হতে যোগ দিয়েছেন সরকারি দলের একটি অঙ্গসংগঠনে।সরকারি কর্মচারী হিসেবে বাবলা দাশের নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্যে উপকৃত হয়েছেন অনেকেই। তবে তার জন্য গুনতে হয়েছে লাখ টাকা।
সমবায়ের প্রভাবশালী এই উচ্চমান সহকারী বাবলা দাশের নিয়োগ-বাণিজ্য, দুর্নীতি, নামে- বেনামে বিপুল অর্থসম্পদ এবং অর্থপাচারের বিষয়ে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় গত ১৬ জানুয়ারি বাবলা দাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। দুদকের সুত্রমতে, সেই অনুসন্ধান চলমান আছে। বিতর্কিত সমবায় নেত্রী বাবলার মা সাধনা দাশগুপ্তের প্রভাবে ২০০৪ সালে চাকরি পান বাবলা দাশগুপ্ত। যোগদান করেই তিনি মেতে ওঠেন নিয়োগ বাণিজ্যে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্ষমতার দাপটে বাবলা দাশ গুপ্ত একাই কয়েকশ মানুষকে চাকরি দিয়েছেন সমবায় অধিদপ্তরে। চাকরি দেবার তার স্বজনও কম নয়। চাকরি দিয়েছেন নিজের ভাই, ভাবী, ভাগনী, মামাতো বোনসহ রয়েছে নিজের অন্তত ২০ জন স্বজন। এভাবেই সারাদেশের সমবায় অফিসগুলোতে গড়ে উঠেছে ‘ বাবলা’ সিন্ডিকেট।
স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়, সমবায় অধিদফতরে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়েছে অনৈতিক লেনদেনের সম্পর্ক। দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের ‘ম্যানেজিং ক্যাপাসিটি’ আছে বাবলার । এসব যোগ্যতার বলে সমবায় অধিদপ্তরের প্রকাশ্য শক্তিশালী সিন্ডিকেট হোতা ‘ বাবলা দাশ গুপ্ত ‘।
জানা যায়, বাবলা দাশ গুপ্ত কিছুদিন আগে কয়েকজনকে ডিঙ্গিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদও। বাবলা দাশের এক ডজনের বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে । এসব হিসাবেই ঘুষের টাকা জমা রাখেন তিনি ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৬ জানুয়ারি সমবায় অধিদফতরে বিভিন্ন ক্যাটাগরির আড়াইশ’ জনের পদোন্নতির পরীক্ষা হয়। পদ প্রত্যাশীদের পদোন্নতির আশ্বাস দিয়ে বাবলা দাশ গুপ্ত ৪ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি ফাঁস হবার কারণে শেষ পর্যন্ত পদোন্নতি বোর্ড মাত্র এক জনকে উত্তীর্ণ করেছে। টাকা দিয়ে পদোন্নতি না পেয়ে সমবায় অধিদপ্তরের বেশ কিছু কর্মকর্তা ফাঁস করে দেন বাবলা দাশ গুপ্তের নানা অপকর্ম। এই ঘটনার পর অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে বদলি করে দেয়া হয়েছে বাবলার অপকর্মের সহযোগী সমবায় কর্মকর্তাদেরও। বাবলা দাশ গুপ্তের কড়া নেটওয়ার্ক রয়েছে সারা দেশের সমবায় কার্যালয়ে।
অনিয়ম আর দূর্নীতিতে যেমন তিনি সিদ্ধহস্ত, তেমনিভাবে সমবায়ের সম্পদ দখল করার খেলায়ও তিনি বেশ পারদর্শী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের লালদীঘির পাড়স্থ সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন ‘নিউ ঢাকা’ নামে একটি আবাসিক হোটেল জবরদখল করেছেন তিনি৷ বাবলা দাশ গুপ্তের ছোট ভাই সমবায় অধিদফতরের তদন্তকারী সঞ্জয় দাশ সম্পত্তিটি দেখাশোনা করেন। সম্পত্তিটির প্রকৃত মালিক ‘জাতীয় সমবায় শিল্প সমিতি’।বাবলা তার বড় বোনকে জাতীয় সমবায় শিল্প সমিতির নির্বাচনে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ‘সভাপতি’ বানিয়ে সমিতির সম্পদে নিজের দখলদারিত্ব বজায় রেখেছেন।
রাজধানীর স্বামীবাগের করাতিটোলায় বাবলা দাশ গুপ্তের মা সাধনা দাশ গুপ্তের নামে রয়েছে ফ্ল্যাট, বাড়ি। সমবায় নেত্রী সাধনা দাশ গুপ্তের বিরুদ্ধেও রয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় লবণ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির জায়গা বিক্রি ও প্লট নির্মাণের মাধ্যমে অর্থ-সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা (স্মারক নং-৪৭.০০.০০০০.০৩২.০৬.১৮৪.১৮.৫০৯) নিতে সমবায় অধিদফতরে পাঠিয়েছে।মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সিদ্ধার্থ শংকর কুন্ড গেল বছরের ২৫ অক্টোবর এ চিঠি দিলেও বাবলা দাশ সুকৌশলে সেটি অভিযোগের তদন্ত ঠেকিয়ে রেখেছেন।
বাবলা দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে বাংলাদেশী হলে তার উপার্জিত অর্থের বেশিভাগই রেখেছেন ভারতে। ভারতের কলকাতায় তার ফ্ল্যাট, প্লট ও বাড়ি রয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে থেকে পড়াশোনা করে বাবলা দাশ গুপ্তের বড় ছেলে শৈবাল দাশ শুভ (পাসপোর্ট নং-বিএফ ০৯৩০৪৭৩)। জানা যায়, দুর্নীতির টাকায় বাবলা দাশ গুপ্ত ফ্লাট কিনে অস্ট্রেলিয়ায় ঠিকানা গড়েছেন৷
নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ এবং দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে বাবলা দাশ গুপ্তের সঙ্গে কথা বলতে গত সোমবার একাধিকবার তার নম্বরে ফোন দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেন নি। গেল সপ্তাহে চট্টগ্রামের আসকার দিঘীর পাড়স্থ নিজের মালিকানাধীন একটি ফ্লাট বিক্রির জন্য সেখানে যান বাবলা দাশ গুপ্ত। প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে সটকে পড়েন সেখান থেকে । পরে বাবলা দাশের দেখা মিলে রহমতগঞ্জ এলাকার একটি রেস্তোরাঁয়। জানা যায়, সেই রেস্তোরাঁর মালিকও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দূর্নীতিবাজ আরেক প্রকৌশলী। সেখানেও প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে সটকে পড়েন বাবলা দাশ গুপ্ত।
স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায় রহমতগঞ্জের ‘ওয়াদি আমিন’ নামেন একটি আবাসিক ভবনের ছয় তলায় ফ্লাট ক্রয় করে বসবাস করছেন বাবলা দাশ গুপ্তের দ্বিতীয় স্ত্রী। সাইফুল ইসলাম নামের একজন জানান, ফ্লাট বাবলা দাশ গুপ্ত ক্রয় করেছেন স্ত্রীর নামে।তার স্ত্রী সমবায় কার্যালয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ।
সুত্রমতে, বাবলা দাশ গুপ্তের হাত অনেক লম্বা। সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তরুন কান্তি শিকদার, সমবায় উপমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সচিব মশিউর রহমানসহ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীদের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। তার কানেকশনে চোখ কপালে তোলা ছাড়া কোন উপায় নেই। প্রভাবশালী আমলা, নেতাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে করেই বাবলা দাশ গুপ্ত হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। বাবলা দাশ গুপ্তের আরেক সহযোগী সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক মুহাম্মাদ গালীব খানের বিরুদ্ধে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে ২ কোটি ১৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ মামলা করে দূর্নীতি দমন কমিশন।
বাবলা দাশ গুপ্তের অনিয়ম দূর্নীতির ফিরিস্তি জানলে চোখ কপালে তুলবেন যে কেউ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে অর্থায়নসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ৪০০ দোকান অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ উঠে। সমিতির অনিয়মকে সমবায় অধিদপ্তরের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বৈধতা দিয়েছেন বাবলা দাশ গুপ্ত।
বাবলা দাশ গুপ্ত ও তার সহযোগীদের অনিয়ম ও দূর্নীতির কারণে অধিদপ্তরের ভেতরেও চলছে নানা প্রশাসনিক অনিয়ম। এসব অনিয়মে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অলিখিত বোঝাপড়া থাকায় ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এসব কারণে সমবায় অধিদপ্তরের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশা। অধিদপ্তরের স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছে স্থবিরতা।
জানা যায়, বাবলা দাশ গুপ্ত ২০১২ সালে চাকরি পাইয়ে দেন ২০১২ সালে অনুজ সঞ্জয় দাশ গুপ্তকে। পদের নাম ‘সরেজমিন তদন্তকারী’। নিয়োগের সর্বনিম্ম যোগ্যতা ছিল বিএ/গ্র্যাজুয়েশন। কিন্তু চাকরি গ্রহণকালে সঞ্জয়ের এই সার্টিফিকেটই ছিল না। অন্যান্য রেকর্ডপত্রের সঙ্গে তিনি দাখিল করেন একটি বিতর্কিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর সনদ। পরে জানা যায়, এই সনদটিও জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা। সঞ্জয় দীর্ঘদিন ধরে সমবায় অধিদফতরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ে কর্মরত।
এছাড়া বাবলা দাশের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচিত জয়শ্রী দাশ। তিনি কর্মরত ছিলেন কক্সবাজার জেলা সমবায় কার্যালয়ে ‘অফিস সহকারী’ পদে। নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকেও সার্বক্ষণিক আগলে রেখেছেন বাবলা। তাকে অফিস সহকারী পদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে ‘প্রশিক্ষক’ পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। নিয়োগ পরীক্ষার সময় জয়শ্রীর পূর্বের পদ-পদবি গোপন রাখা হয়। তিনিও এখন চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত।
একইভাবে প্রথম স্ত্রী মীরা প্রভা নন্দীর আপন বোন মঞ্জু প্রভা নন্দীকে বাবলা চাকরি দেন ‘অফিস সহায়ক’ হিসেবে। জানা গেছে ; জাল সনদের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া মঞ্জু প্রভা নন্দী এখন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা সমবায় কার্যালয়ে কর্মরত।
বাবলা দাশ গুপ্ত তার ভাগ্নি নীতি রানী পালকে চাকরি পাইয়ে দেন পরিদর্শক পদে। তিনি এখন কক্সবাজার কার্যালয়ে কর্মরত আছেন । বাবলা দাশ গুপ্ত মের ভাইয়ের স্ত্রী শাপলা প্রভা দে’ কে পরিদর্শক পদে চাকরি দেন। তিনিও বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। বাবলা তার মামাতো বোন পল্লবী দাশ গুপ্তকে চাকরি পাইয়ে দেন ‘অডিটর’ পদে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ে কর্মরত আছেন বাবলার এই মামতো বোন।এছাড়া ‘প্রশিক্ষক’ পদে রয়েছেন বাবলা দাশের শ্যালিকার ছেলে প্রণয় নন্দী। নিজের অনিয়ম দূর্নীতির সুবিধার্থে বাবলা দাশ গুপ্ত তাকে রেখে দিয়েছেন প্রধান কার্যালয়েই। একই দফতরে ‘সহকারী প্রশিক্ষক’ পদে কর্মরত আছে বাবলা দাশ গুপ্তের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জয়শ্রী দাশের ছোট বোন শাপলা দাশও।
বাবলার শ্যালিকার মেয়ে পল্লবী কেয়া চক্রবর্তী অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করছেন অধিদফতরের হেড অফিসে। স্ত্রীর মেজ ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী বিন্দু রানী পাল ‘উপজেলা সমবায় অফিসার’ হিসেবে রয়েছেন মুন্সিগঞ্জ, সিরাজদিখানে। বাবলা তার ছেলের গৃহশিক্ষক ‘শ্যামল চন্দ্র রায়’কে চাকরি পাইয়ে দেন সমবায়ের পরিদর্শক পদে। পর্যায়ক্রমে চাকরি দিয়েছেন শ্যামলের স্ত্রী প্রমিলা রানী রায়কেও। তিনি সমবায় অধিদফতর, ঢাকা অফিসের ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত। শ্যামল চন্দ্রের ভাই তাপস কুমার রায়কেও চাকরি ডুকানো হয়েছে । তিনি ‘ফিল্ম অপারেটর’ হিসেবে অধিদপ্তরে কর্মরত আছেন ।
সুত্রমতে, দুর্দান্ত প্রতাপশালী বাবলা দাশ গুপ্তের প্রথম স্ত্রীর আরেক বোন নোয়াখালী বেগমগঞ্জ উপজেলা সমবায় অফিসার পদে। নরসিংদীতে কর্মরত প্রথম স্ত্রীর ভাই নয়ন নন্দী। অভিযোগ রয়েছে, এসব ব্যক্তির অধিকাংশকেই চাকরি দেবার জন্য বাবলা দাশ গুপ্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র জাল করেছেন।
সমবায় অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী বাবলা দাশ গুপ্তের অন্তত পঁচিশ জন আত্মীয় কর্মরত আছেন সংস্থাটিতে। নিজের স্ত্রী, নিজের ভাই, ভাগ্নি, শালিকা- বাবলার পুরো পরিবার নিয়েই যেন সমবায় অধিদপ্তর। নিজের তদবিরে চাকরি হয়েছে অন্তত পাঁচশো জনের। ঢাকা, ফেনী, পটিয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার শহর, টেকনাফ – বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি বাবলা দাশ গুপ্ত।।