::: নাদিরা শিমু, নেওয়াজ তুহিন :::
চসিকের আড়াই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলা ও তার কার্যালয় ভাংচুরের ঘটনায় গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবার কথা থাকলেও তেইশ দিন সময় লেগেছে এই প্রতিবেদন তৈরি করতে।
তদন্ত প্রতিবেদনে মারধরের শিকার হওয়া প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীর উপরও দায় চাপানো হয়েছে। গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারার দায় প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী, প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপ প্রকল্প পরিচালক জসিম উদ্দিনের। টেন্ডারের ব্যয় প্রাক্কলন সংক্রান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারেন নি সংশ্লিষ্টরা।
বলা হয়েছে প্রকৌশল বিভাগ থেকে দরপত্র সংক্রান্ত গোপন তথ্য ফাঁস হবার কারণে ক্ষুব্ধ ঠিকাদারদের হাতে প্রকল্প পরিচালককে মারধরের শিকার হতে হয়েছে। যান্ত্রিক শাখার তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আকবর হোসেন প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর পাশ্ববর্তী রুমে অবস্থান করার পরও তিনি ঘটনাটি আঁচ করতে পারেন নি। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে রক্ষা করতে এগিয়ে যান নি – বিষয়টি নিয়েও নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে৷ চসিকের নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ ২৮ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর শুনানি শেষে গতানুগতিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে দশটি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সাক্ষ্য নেয়া ২৮ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর নাম উল্লেখ করা হলেও তাদের মধ্যে চারজন ঘটনার সময় চসিক কার্যালয়ে উপস্থিতই ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাংচুর হওয়ার কক্ষটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করে নি প্রকৌশল ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভাংচুর হওয়া কম্পিউটার, নামফলক ও অন্যান্য দ্রব্যাদি কত টাকায় কেনা হয়েছে সেই হিসাবের রশিদ উপস্থাপন করেন নি সংশ্লিষ্টরা। রশিদ উপস্থাপন না করার কারণে দায়িত্ব প্রাপ্তদের শোকজের সুপারিশও করেন নি তদন্ত কমিটি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একাধিক সুত্র জানিয়েছেন, ঠিকাদারদের মধ্যে যাদের নেতৃত্বে হামলা করা হয়েছে তাদের অনেকেই উপ প্রকল্প পরিচালক জসিম উদ্দিন ও বিদ্যুৎ উপ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের ব্যবসায়ীক পার্টনার। গ্রেফতার হওয়া ঠিকাদার ‘কংকন ও আশিষ ‘ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছের মানুষ হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু সাদামাটা গা বাঁচানো তদন্ত প্রতিবেদনে এই সংক্রান্ত কোন তথ্যই উপস্থাপন করা হয় নি।
হামলার ঘটনার আগে ও পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত কোন প্রতিবেদনকে সুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি। প্রকৌশলীদের সম্পর্কে গণমাধ্যমে উঠে আসা অভিযোগ ‘তদন্ত কমিটি’ তদন্ত করেছে কিনা সেটিও উল্লেখ করা হয় নি।
তদন্ত কমিটি ক্ষুদ্ধ ঠিকাদাররা এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে বলা হলে, কোন কোন ঠিকাদারের সাথে তদন্ত কমিটির সদস্যরা কথা বলেছেন , সেটিও উল্লেখ নেই প্রতিবেদনে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৌশল বিভাগে প্রকৌশলীদের গোপনে টেন্ডার দফারফা, দরপত্রে অনিয়ম, ২৫ লটের কাজে ১৩ টি প্রতিষ্ঠানকে লটারি না করে কাজ দেয়ার – কোন তথ্যই তদন্তে আনা হয় নি। অথচ ১৩ টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কার্যাদেশ প্রদান করেছিলেন উপ প্রকল্প পরিচালক জসিম উদ্দিন। মারধরের শিকার হওয়া প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানী এসব কাজের কার্যাদেশ কেন প্রদান করেন নি, কিংবা কেনই বা তিনি দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন – এসব তথ্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে। মারধরের শিকার হওয়া প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীও বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে শিকার করেছেন। জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর উপর প্রকৌশলীরা ক্ষুব্ধ হবার অন্যতম কারণ এসব কাজের কার্যাদেশ।
হামলার ঘটনার আগে সংস্থাটির কোন কর্মকর্তা কর্মচারী জড়িত ছিল কিনা, সেই বিষয়টি মাথা রেখে তদন্ত করার কথা বলা হয়েছিল ঘটনার পর। কিন্তু প্রতিবেদনে সুকৌশলে বিষয়টির কোন উপসংহার টানা হয় নি। প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলার নেপথ্য কারন সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া হয় নি প্রতিবেদনে। উল্টো প্রকল্প পরিচালকের উপরও দায় চাপানো হয়েছে
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্যরা কথা বলতে রাজি হন নি। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সুত্রমতে, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী মন্ত্রণালয়ের তিন সদস্য তদন্ত দল চট্টগ্রামে আসার কথা রয়েছে। ৪১ টি ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজের গুনগত মান সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আসলেও ; গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলার ‘ তদন্ত প্রতিবেদন ‘ নিয়েও যাচাই বাছাই করা হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্যালয়ে হামলার বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। তাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে চসিকের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে না। প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী যাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে না ফিরেন সেই উদ্দেশ্যেই হামলা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে হামলাকারীদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সুত্রমতে, ১১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার বিষয়টিও লোক দেখানো। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সকল ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রক নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন নতুন করে এই প্রকল্পের পিডি হবার দৌড়ে এগিয়ে আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী বলেন, ‘ কার্যালয়ে ডুকে প্রকল্প পরিচালককে মারধর করার সাহস এসেছে যে জায়গা থেকে সেই মহল থেকেই অভিযুক্ত চারজনকে গ্রেফতার করার পর তদবির করা হয়েছে । দুলাল নামের ওই ব্যক্তি উপর মহলের লোক। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কি এলো না এলো ভেবে সময় ক্ষেপণ না করাই শ্রেয়। সবার কাছেই হামলার উদ্দেশ্যসহ ঘটনাটি পরিস্কার। দেখবেন যারা হামলার ঘটনার সাথে জড়িত, সেসব ঠিকাদারদের চসিকে কাজও দেয়া হবে -হয়তো ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। ‘
প্রকৌশল বিভাগের একই প্রকৌশলী বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে, এমন ঘটনায় জড়িত এগারোটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নথি ফাঁস করার জন্য মারধরের শিকার হওয়া প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীর উপরও দায় চাপানো হয়েছে। অথচ কারা কারা কাজ বিক্রি করেন, দরপত্রের প্রাক্কলন ফাঁস করেন ; তাদের বিষয়ে কিছুই ওনারা পান নি। যেসব সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলোর তদন্তের প্রয়োজন নেই। কালো তালিকাভুক্ত করার বিষয়টিও স্পষ্ট আইওয়াশ। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জাইকার চলমান এলইডি প্রকল্পের ঠিকাদার। এলইডি বাতির প্রকল্পে ‘এইচটিএমএস ‘ নামের প্রতিষ্ঠানটি নিম্মমানের কাজ করার বিষয় চসিকের আরেকটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিলো। অথচ সেই প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে পরবর্তী এলইডি প্রকল্পের দরপত্র মুল্যায়নে সর্বোচ্চ নাম্বার দিয়ে এগিয়ে দেয়ার নজির রয়েছে। ভারতের নমনীয় ঋণ সুবিধায় ২৬২ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্পে উপ ঠিকাদার হিসেবে কাজ পাইয়ে দেবার অপকৌশলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক ঝুলন কুমার দাশের বিরুদ্ধে কোন দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া হয় নি ; এটি এই সংস্থার বাস্তবতা।
এদিকে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দাপ্তরিক গোপনীয়তা রক্ষায় প্রকল্পের টেন্ডার কার্যক্রমের প্রত্যেক ফাইল নিয়মতান্ত্রিক এবং স্বচ্ছতা রক্ষা, অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস রোধে যত্মবান হওয়া, টেন্ডার প্রক্রিয়া চলাকালে ঠিকাদার বা তাদের লোকজনের অপ্রয়োজনীয় অনুপ্রবেশ সংরক্ষিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তা ছাড়া নগর ভবনে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কর্মকর্তাদের রুমে ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম সিস্টেম, গেটে রেজিস্ট্রার সিস্টেম, প্রত্যেক ফ্লোরে কমপক্ষে দুজন করে নিরাপত্তা প্রহরী, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, অফিস টাইমে বহিরাগতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, চসিকের নিরাপত্তা বিভাগে কর্মরতদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, সহকর্মীদের সঙ্গে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধিসহ ১০টি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক , সচেতন নাগরিক কমিটি,কর সুরক্ষা কমিটির বেশ কয়েকজন জানান, নগর, নাগরিক ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশন ‘ অনুপ্রবেশ সংরক্ষিত’ করতে পারে কিনা সেটির আইনী ব্যাখার প্রয়োজন। তারা যদি গোপনে চুরি করতে চান সেটি ভিন্ন কথা। ‘