:::নেওয়াজ তুহিন :::
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলার ঘটনার নেপথ্যে চসিকের প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলীদের দায় রয়েছে। প্রকল্পের দরপত্রের গোপন তথ্য ঠিকাদারদের কাছে ফাঁস করে দেয়া হয়েছে টেন্ডারের আগেই৷
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির তাদের প্রতিবেদন চসিকের মেয়র রেজাউল করিমের কাছে জমা দিয়েছেন বুধবার। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায় সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, সাক্ষ্যগ্রহন শেষে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে মেয়রের কাছে । ঠিকাদারদের কাছে দরপত্র ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে মুল্যায়নের বিষয়টি প্রকৌশল বিভাগ থেকে প্রচার করা হয়েছে ; তদন্তে জানা গেছে৷ ঠিকাদারদের কাছে দরপত্রের গোপন তথ্য ফাঁস করার সাথে সংস্থাটির কর্মকর্তারা জড়িত থাকার আলামতও পাওয়া গেছে। সিডিউলের গোপন তথ্য ফাঁস হবার কারণেই হামলার মতো পরিস্থিতি সৃস্টি করা হয়েছে।
সিডিউলের গোপন তথ্য ফাঁস হবার কারণেই হামলার মতো পরিস্থিতি সৃস্টি করা হয়েছে।
গেল মাসের ২৯ শে ডিসেম্বর বিকেলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে ঠিকাদারদের কিছু লোকজন জড়ো হয়ে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলা চালায়। ঘটনার পর চসিকের নিরাপত্তা কর্মকর্তা বাদী হয়ে খুলশী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় দশ ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে।
ঘটনার পরদিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা শামসুল তীবরীজকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করে চসিক। এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবার কথা থাকলেও তিন সপ্তাহ পর তড়গড়ি করে তদন্ত প্রতিবেদন চসিকের মেয়রের কাছে জমা দিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সুত্র জানিয়েছে, গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলার ঘটনায় চসিকের পক্ষ থেকে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ; সেটি জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। ২০ শে ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সেই চিঠির জবাব দিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে চসিকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্প পরিচালকের উপর হামলার ঘটনায় চসিকের পক্ষ থেকে মানববন্ধন করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বাড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরের মতো নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে আইটি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে উন্নত প্রযুক্তির নিরাপত্তা সরঞ্জামের সংযুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও জানানো হয়েছে। ১১ টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলেও জানান প্রধান প্রকৌশলী। কিন্তু চসিকের তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা জানানো হলেও, সেই কমিটির প্রতিবেদন সংক্রান্ত কোন আপডেট দেয়া হয় নি। চিঠি পাঠানোর একদিনের মাথায় বুধবার তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় চসিকের মেয়রের কাছে৷। তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন দরপত্র ও দাপ্তরিক গোপনীয়তা রক্ষায় দশটি সুপারিশ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির আহবায়ক শামসুল তাবরিজ নিজেই। তদন্ত কমিটি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণসহ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তবে তদন্ত কমিটি ‘ সংস্থার ‘ দূর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের সম্পর্কে কোন সুপারিশ করেছে কিনা সেটি জানাতে রাজি হন নি কমিটির সদস্যরা।
চসিকের সুত্রমতে, ঠিকাদারদের ব্যবহার করে প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় একটি পক্ষ কমিশনে টেন্ডার বিক্রির সুবিধা নিতে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর উপর হামলা করায়। বিষয়টি পৌঁছে গেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে। মারধরের শিকার হওয়া প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানী চসিকে যোগ দেন নি৷ এরমধ্যে নগরের ৪১ ওয়ার্ডে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের গুনগত মান যাচাই করতে ২৫ ও ২৬ শে ফেব্রুয়ারী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম আসছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মাহবুবুর রহমান, পলি কর, স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক দুইদিন সরেজমিনে চসিকে এসে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের মান যাচাই করবেন।
মন্ত্রণালয়ের সুত্রমতে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারী ইআরডি কার্যালয়ে চসিকের বিদ্যুৎ উপ বিভাগের অন্য একটি প্রকল্পের ‘পরিচালক’ সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে ইআরডি,ভারতের দুতাবাস, এক্সিম ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে। সেই প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাথে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্পষ্ট দুরত্ব তৈরি হয়েছে।
সুত্রমতে, হামলার সাথে জড়িত চার ঠিকাদারকে গ্রেফতারের পর তাদের রিমান্ড না চাওয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তদবির করেছেন জনৈক ‘ দুলাল নামের এক ব্যক্তি ‘। ঠিকাদারকে কাছ তথ্য পেতে তদন্ত কর্মকর্তাকে রীতিমতো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার হওয়া ঠিকাদারকে জিজ্ঞেসাবাদ ও কল রেকর্ড বিশ্লেষণ করে এই হামলার সাথে চসিকের প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলীদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে। সেই বিষয়ে চসিকের নিজস্ব তদন্ত কমিটি কি পেয়েছে- সেটির উপর মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চসিকের এক কর্মকর্তা জানান, ঠিকাদারদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক চসিকে না আসলে যারা বেনিফিসিয়ারি হবেন – তারাই হামলার নেপথ্য নায়ক। চসিকের শীর্ষ কর্তার ইশারা ছাড়া ঠিকাদারদের পক্ষে কার্যালয়ে ডুকে প্রকল্প পরিচালকের উপর হামলা করা অসম্ভব। এছাড়া চসিকের অন্য সব সাধারন সভায় বেশ কিছু কাউন্সিলর প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিষোদগার করে আসলেও; ঘটনার দিন সাধারন সভায় কেউই তাকো কিছু বলেন নি। ঠিকাদারীর কার্যাদেশ ইস্যু না করার কারণে গত তিনমাস ধরে কাউন্সিলররা সাধারণ সভায় প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে তুলোধুনো করে আসছিলেন। কিন্তু হামলার দিন সাধারণ সভায় বিষয়টি নিয়ে নিরব থেকেছেন সেসব কাউন্সিলর ও প্রকৌশলীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প পরিচালকের উপর কার্যালয়ে ডুকে হামলার কারণ স্পষ্ট। এই ঘটনার নেপথ্যে কারা সেটিও স্পষ্ট – এমন বাস্তবতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপর চরম ক্ষুব্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী।
তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন দরপত্র ও দাপ্তরিক গোপনীয়তা রক্ষায় দশটি সুপারিশ করা হয়েছে।