:::বিশেষ প্রতিবেদক:::
দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প অর্থনীতিতে এরই মধ্যে শক্ত একটি জায়গা তৈরি করে নিয়েছে আরএফএল গ্রুপ। এ ছাড়া দেশের হয়ে রপ্তানির অন্যতম খাত হয়ে ওঠা এই শিল্প বিশ্বদরবারেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এই খাতেও নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘প্রাণ’। আরএফএল- প্রাণ এর পণ্য এখন বিশ্বের ১৪৫টি দেশে পৌঁছে গেছে। রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সরকারের কাছ থেকে পরপর ১৬ বার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি পাওয়া ‘ আরএফএল’ লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেল খু্ব একটা ব্যবহার করে না ; এমন অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটি ডিলারসহ, পণ্য সরবরাহকারীদের। দেশের আর্থিক খাতে ক্রমবর্ধমান তারল্য সংকট বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই ‘ নগদ নারায়ণ’ পলিসি। জানা গেছে এমন নীতির নেপথ্যে রাজস্ব ফাঁকি দেবার কূটকৌশল ।
প্রতিষ্ঠানটি দেশজুড়ে শতশত আউটলেট রয়েছে যেখানে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরেও আরএফএল’র রয়েছে বিশাল বিক্রয় ও বিপণন ব্যবস্থাপনা। তবে প্রতিষ্ঠানটি সবকিছুই করে থাকে নগদে। আর ব্যাংকিং চ্যানেলে কৌশলী লেনদেন করে থাকে তারা।
সুত্রমতে, প্রতিষ্ঠানটির বেশ কিছু হিসাব রয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবের অধিকাংশই শুল্ক ও রাজস্বের সাথে সম্পৃক্ত নয়। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, অধিকতর তদন্ত করলেই এই প্রতিষ্ঠানের এমন কূটকৌশল বেরিয়ে আসবে। ব্যাংক লেনদেনে অনীহা, নগদ লেনদেনের প্রতি অতি আগ্রহের মাঝে লুকানো আছে দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট পলিসি ও রাজস্ব ফাঁকির ফাঁদ।দেশে শীর্ষ ১০টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম এই গ্রুপ। বাণিজ্যিক ভলিউম বড় হলেও সরকারের রাজস্বখাতে (রপ্তানি ছাড়া) ভ্যাট-ট্যাক্স দেবার মাপকাঠিতে আরএফএল রয়েছে অনেক পেছনে।
সুত্রমতে, ভ্যাট ও টাক্সের অংকে সরকারকে রাজস্ব দেবার ক্ষেত্রে আরএফএল’র অবস্থান ছোটোখাটো কোম্পানির মতোই। আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশের শীর্ষ রাজস্ব ফাঁকিবাজদের তালিকায় উপরের দিকেই রয়েছে ‘আরএফএল’। রাজস্ব বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের হাত রেখে চলে প্রতিষ্ঠানটি।দীর্ঘদিন ভ্যাট ও প্রণোদনা জালিয়াতি করে দেশের শিল্প-বাণিজ্যের বেশকিছু খাত দখলে নিয়ে অসম প্রতিযোগীতা তৈরি করেছে ‘ আরএফএল’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার দখলে আরএফএল’র ‘কম মুল্যনীতি’র দৌরাত্ম্য মাঝারি মানের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারে টিকে থাকাই দায় হয়েছে পড়েছে । অল্প সময়ে বিশাল কর্পোরেট গ্রুপে পরিণত হবার পেছনেও ভ্যাট ফাঁকি দিতে তাদের নগদ লেনদেন ও স্বল্পমুল্য পলিসি।রাজস্ব খাতে ঘন্টা বাজিয়ে এখন দেশের অর্থনীতিতে সংকটের পদধ্বনি দেখা গেলেও ভালোই আছে আরএফএল এরমতো প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনাসহ বর্তমান মন্দা অবস্থা কোন প্রভাবে ফেলেনি প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক বিক্রয় ভলিউমে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দেবার কূটকৌশলও বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। একই নামের প্রতিষ্ঠান রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেডের ভিন্ন ভিন্ন পণ্য। কোন চালানে কি আসছে ভ্যাট বা শুল্ক গোয়েন্দারা তা সহজে ধরতেই পারে না। এর অন্যতম কারণ দৈনিক লেনদেনের বড় অংশই নগদে হচ্ছে। দেশের প্রত্যক্ষ অঞ্চলে ব্যাংক পৌঁছে গেলেও বিক্রির টাকা কার্যালয়ে জমা নেয়া হয় নগদে। এটাই অলিখিত নিয়ম। এমন কি শ্রমিকদের বেতনও পুরোপরি ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রদান করে না।
কাঁচামাল আমদানী ক্ষেত্রে একই নামের চালান হবার কারণে একই চালান দিয়েই বারবার পণ্য খালাসে সিদ্ধহস্ত তাদের কমার্শিয়াল বিভাগের কর্মকর্তারা। বন্দর থেকে বের করার পর আবার কোন ট্রাকে কোন কাঁচমাল নিচ্ছে তাও নির্ণয় করা বেশ কঠিন।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে ফ্যাক্টরী। কাগজে কলমে এক ধরনের পন্যের কারখানা, কিন্তু তৈরি করা হচ্ছে ভিন্ন পণ্য। সুত্রমতে, কোথায় কোন প্রডাক্ট উৎপাদন হচ্ছে তার সঠিক কোন তথ্য নেই সরকারের তদারককারী সংস্থার কাছে। সিরাজগঞ্জ, নাটোর, হবিগঞ্জে প্রাণ-আরএফএল তাদের কারখানায় পরিবেশ দূষণ করছে। এখানে এই গ্রুপের ৫টি কারখানা আছে। আইন অনুযায়ী বর্জ্য শোধনাগারের (ইটিপি) মাধ্যমে বর্জ্য শোধন করে বাইরে ফেলার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। রাতের আঁধারে অপরিশোধিত বর্জ্য উন্মুক্ত খালে ফেলা হয়। এই কোম্পানির তরল বর্জ্যের কারনে হুমকির মুখে সুতাং নদী।
অন্যদিকে, আমদানীর ক্ষেত্রে এ-গ্রেড কাঁচামালের ঘোষণা দিয়ে সি-বা ডি-গ্রেড এর কাঁচামাল আমদানী করে প্রতিষ্ঠানটি ওভার ইনভয়েসের কূটকৌশল অবলম্বন করছে। শুধু তাই নয় রফতানির বিপরীতে বিভিন্ন প্রণোদনা সুবিধা পেতে বাড়তি রপ্তানি দেখানো হয়ে থাকে দীর্ঘদিন থেকে।
অনুমোদনহীন পণ্য রপ্তানি করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রাণ ডেইরি ৩৫৬ কোটি টাকার নগদ সহায়তা তুলে নেয় চারটি অর্থবছরে (২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০)। ৩টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ সহায়তা গ্রহণ করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো আপত্তি তোলা হয়নি।
তবে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীনস্থ সিভিল অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় গুরুতর এ অনিয়ম ধরা পড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তুলে নেওয়া অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে সুপারিশ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচামাল আমদানি, পণ্য উৎপাদন, সেসব পন্যের সঠিক রপ্তানির পরিমাণ এবং প্রণোদনার নেবার অংক- এসব তথ্য নীরিক্ষা করলেই বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়বে।
অবৈধভাবে জমি দখল, পরিবেশ দূষণ, রাজস্ব ফাঁকি ও বাজারে মানহীন পণ্য বিক্রি করলেও তদারককারী সংস্থার সবাই নিরব। এ নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। উল্টো দুর্নীতির তথ্য ধামাচাপা দিতে প্রাণ-আরএফএলের সঙ্গে আঁতাত করছে কেউ কেউ।
প্রাণ-আরএফএলের নিম্মমানের পণ্যসামগ্রী এবং কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিতে প্রতিষ্ঠানটি নানামুখী অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ভোক্তা হয়রানির বিষয়ে জানতে বেশ কয়েকদফা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক কামরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেন নি।এছাড়া জনসংযোগ কর্মকর্তা তাওহিদের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনিও কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি ।